ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস।এই মাসে যতবার পতাকা উত্তোলিত হয় সারা মাস ব্যাপী ততবার তা উত্তোলন হতে দেখা যায় না।শহরের অলি-গলি পেরিয়ে উঁচু বিল্ডিংয়ের কার্ণিশেও পত পত করে উড়তে দেখা যায় লাল সবুজের পতাকা।বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে যখন কানের পর্দায় ভেসে আসে “এক সাগর রক্তের বিনিময় বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলো যারা”।
মন ছুটে যায় কোন এক অজানায় সেই অনুভূতি বোঝা যায় কিন্তু বুঝানো যায় না।শুধু নিজের ভেতরটাই ওলট-পালট হতে থাকে। সেদিন অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও দেখলাম সঠিক নামটি তাঁর মনে নেই তবে তিনি বিজয়ের মাসে স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নিজের পরিবারের ভয়াবহ ঘটনার তুলে ধরলেন নতুন প্রজন্মের কাছে।
তাঁর ভাস্যমতে,তাঁর বাবা ছিলেন রেলওয়ের প্রকৌশলী স্বপরিবার নিয়ে একটি দোতলা বাড়িতে বাস করতেন।অত্যান্ত দেশপ্রেমিক ছিলেন,দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তাই তিনি বাড়িতে একটি বাংলাদেশের পতাকা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন।আর এই পতাকার জন্যই পরিবারে নেমে এলো আমাবস্যার ঘোর অন্ধকার।সেদিন ছিলো ১৪ ডিসেম্বর১৯৭১সাল হঠাৎ দরজায় কড়া নড়ে ওঠলো!ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বুঝতে পারলেন কোন অশনি সংকেত তাই তাঁর চার ছেলে ছোট এক মেয়ে এবং স্ত্রী কে খাটের নীচে লুকিয়ে রেখে দরজা চেপে ধরেছিলেন।
ভাগ্য খারাপ পাক সেনারা দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে ব্যানেট দিয়ে খু্ঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করলেন।তিনি মাটিতে পরে গেলেন স্ত্রী সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিয়ে খাঁটের নীচ থেকে বেড়িয়ে এসে বাঁধা দিতেই তাকেও আঘাত আর নির্যাতন শুরু করলেন,বাচ্চারা কান্নাকাটি শুরু করলো,এরপর বাচ্চাদেরও নির্যাতন শুরু করলো, এবার স্বামীকে ছেড়ে বাচ্চাদের রক্ষা করার জন্য আকুতি,মিনতি শুরু করলেন,বললেন আমাকে মেরে ফেলো আমার বাচ্চাদেরকে ছেড়ে দাও!
ছোট ছেলেটি একেবারে চুপচাপ খাটের নীচ থেকে বের হয়নি, লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার মৃত্যু,মায়ের মৃত্যু, বড় তিন ভাইয়েদের ওপর নির্যাতন সবই দেখেছে।ছোট বোনটি কিভাবে যেন ছিঁটকে খাটের নীচে এসেছে।বোনকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।এর পর নিস্তব্ধ! কোন সাড়া শব্দ নেই! ছোট বোনটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে খাটের নীচ থেকে বেড়িয়ে এলো —চিৎকার শুরু করে বললো তোমরা কেউ কি বেঁচে আছো।সাড়া পেলো তিন ভাই বেঁচে আছে আহত অবস্হায় রাস্তায় নেমে এলো হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করালো। অনেক সাহায্য চেয়েছে গগণবিদারী আর্তনাদ ধ্বনিতে আকাশ কেঁপে উঠেছিলো সেই আর্তনাদের শব্দ শহরের অলিগলি পেরিয়ে শূণ্যে মিলিয়ে গেল।
অসহায় অবস্হায় হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে পথে পথে হাটছে কেউ নেই তাদের। বিশাল এই আকাশের নীচে বড়ই অসহায়।অনেক কষ্টে একজন ডাক্তার মিললো তাদের থাকা আশ্রয় দিলো।পরের দিন হাসপাতালে গেলো ভাইদের দেখার জন্য কোথাও খুঁজে পেলনা।
এর পর হাসপাতালের লোকজনের থেকে জানতে পারে কয়েকজন লোক এসে ফুসলিয়ে বাহিরে নিয়ে গেছে যে,ভাই এবং বোনের নিকটি নিয়ে যাবে এই বলে।পরে তাদের মেরে একটি ডোবার মধ্যে ফেলে দেয়।আর তাদের বাবাকে বাড়ির উঠানেই পুঁতে রেখেছে। ওর মাকেও জীবিত অবস্থায় মাটি চাপা দিয়েছে, যখন মাটি চাপা দিচ্ছিলো তখন দেহে প্রাণ ছিলো।
মা,বাবা,তিন ভাইয়ের শোক বুকে ধারণ করে ৪৬টি বছর পার করে দিয়েছে।ছোট বোনটিকে নিয়ে আজও এই লাল সবুজের পতাকার দেশে বেঁচে আছে।বিজয় মাসের কোন অনুষ্ঠানে তিনি আসতে চান না।বুকের ভেতর কষ্টের পাহাড় জমে আছে।আজও তাঁর চোখে ভাসে মা,বাবা,ভাইদের রক্তমাখা দেহ।
এই পতাকার জন্য এদেশের সোনার ছেলেরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে,মা/বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছে।কত আশা,কত স্বপনের মৃত্যু ঘটেছে তাঁর হিসেব নেই।
ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দু’লক্ষ মা,বোনের সম্ভ্রমের বিনিময় আমাদের অর্জিত এই স্বাধীনতা।লাল, সবুজের এক খন্ড পতাকা।
“স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন”।এই স্বাধীনতা রক্ষা করা আমাদের দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য। এক খন্ড পতাকার জন্য দেশের মানুষ নয় মাস সংগ্রাম করেছে।বনে,জঙ্গলে, রাস্তা,ঘাটে দিন কাটিয়েছে।পৃথিবীর কোন জাতি বাঙ্গালি জাতির মত এত ত্যাগ স্বীকার করেনি।এত রক্ত, এত লাশ কোন জাতিকে দেখতে হয়নি যেটা বাঙ্গালি জাতির ক্ষেত্রেই ঘটেছে।আজও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে,আজও বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আজও মহান মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরে আঘাত পরে তখন লজ্জায়,ঘৃণায় মাথা নীচু হয়ে যায়। এই লজ্জা আমাদের! সমগ্র বাঙ্গালি জাতির। এদেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে দু’বেলা পেট ভরে খাবার পাবে আর নিরাপদ নীড়ে বাস করবে সেই স্বপ্ন নিয়েই তাঁরা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলো। সেই স্বপ্ন পূরণের পথে! কিন্ত এই স্বাধীন দেশে এখনও পথে ঘাটে লাশ পরে।
ধর্ষণ,নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয় কিন্তু কেন? বিজয়ের মাসে এক খন্ড পতাকা আমাদের সমস্ত লজ্জা ঘৃণা মুছে স্বপ্নের সকালে আকাশে পত পত করে উড়বে! সেই স্বপ্ন এখনও দ্যাখে এ দেশের মানুষ।আমরাও প্রবাসে বসে দেশ এবং দেশের মানুষের মুখে হাসি দেখে আনন্দিত হই,উদ্বেলিত হই।বুক তখন ভরে ওঠে সীমাহীন ভালোলাগায়।
Leave a Reply