দেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে একটি বিরাট ডিজাস্টার হয়ে গেছে, যার রেশ এখনো চলমান। একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন করে সামনে এসেছে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা, নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা, স্বকীয়তা, গণমাধ্যমের ওপর মালিক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের চাপ, মূলধারা বনাম ভূঁইফোড় সংবাদমাধ্যম এবং সর্বোপরি গণমাধ্যম বনাম সোশ্যাল মিডিয়ার প্রসঙ্গ।
প্রশ্ন উঠেছে- গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ নিয়ে। অনেকে গণমাধ্যমকে এখন শুধুই ‘প্রচারমাধ্যম’ বলা হবে কি-না, সে প্রশ্নও তুলেছেন।
ঘটনার সূত্রপাত দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের একজন ‘প্রেমিকার’ মৃত্যু নিয়ে। বলা হচ্ছে, এটি আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে আনভীরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে তার পরিবার। যদিও তাদের তরফে এটিকে হত্যাকাণ্ড বলেও দাবি করা হচ্ছে। যদি তাই হয়, তাহলে কেন আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করা হলো বা তারা আসলে হত্যা মামলা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু পুলিশ কি হত্যা মামলা নেয়নি- এমন প্রশ্নও রয়েছে। এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা সেটি সঠিক তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে।
সম্প্রতি মূল সমস্যার সূত্রপাত এই ঘটনার সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার নিয়ে। সাংবাদিকতার একেবারে প্রাথমিক পাঠেই বলা আছে যে, ভিকটিমের ছবি প্রকাশ করা যাবে না। প্রয়োজন হলে ছবি ঝাপসা করে দিতে হবে; কিন্তু এই ঘটনায় দেখা গেল উল্টো কাণ্ড। দেশের দুটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ভিকটিম তরুণীর ছবি স্পষ্ট থাকলেও অভিযুক্ত আনভীরের ছবিটা ঝাপসা, যা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে পুরো সাংবাদিকতাকে। সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতাকে।
শুধু তাই নয়, দেশের দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যমগুলোও শুরুতে বসুন্ধরা গ্রুপের নাম উল্লেখ না করে কেবল দেশের শীর্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লিখেছে; কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার অব্যাহত চাপে পরে বসুন্ধরা গ্রুপ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম উল্লেখ করে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীন?
শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি : পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে
এরপর শুরু হয় ওই এমডির বান্ধবী বা প্রেমিকার বিরুদ্ধে কথিত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি সংবাদ চ্যানেলের অনলাইনের কয়েকটি শিরোনাম এরকম : ১. মুনিয়ার চার প্রেমিক! ২. লাখ টাকার ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন তরুণী, ৩. অভিনেতা বাপ্পীর সঙ্গে গভীর প্রেম ছিল মুনিয়ার, ৪. মুনিয়ার ডায়েরিতে কী আছে? ৫. উনি আমাকে ভোগ করেছেন, বিয়ে করবেন না, ৬. মুনিয়ার মৃত্যু, অডিও ক্লিপ ভাইরাল।
কয়েকদিন পরে এই দৌড়ে নামে কয়েকটি সংবাদপত্রও- যার মধ্যে দু-একটি দায়িত্বশীল সংবাদপত্রও রয়েছে। এসব সংবাদপত্রে মূলত ওই তরুণী ও তার পরিবারের বিষোদ্গার করা হয়। সংবাদের যে ভাষা তাতে এটা ধারণা করা যুক্তিসঙ্গত যে, এটি বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে লিখে পাঠানো হয়েছে এবং এই সংবাদগুলো ছাপতে অনেক টাকা খরচ করা হয়েছে। অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে একটি বিবৃতি হুবহু ছাপানো হয়েছে- যাকে সংবাদ না বলে বিজ্ঞাপন বলাই সঙ্গত।
গণমাধ্যমের এহেন আচরণের তীব্র সমালোচনা শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। শুধু একাডেমিক সমালোচনা নয়, বরং অকথ্য ভাষায় গালাগাল এবং সামগ্রিকভাবে পুরো সাংবাদিকতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়। সাংবাদিকদের প্রতি যারা নানা কারণে বিরূপ, তারাও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষোদ্গারের এই সুযোগটি কাজে লাগান। অস্বীকার করার উপায় নেই, এই পরিস্থিতি তৈরির জন্য সাংবাদিকদের একটি বিরাট অংশই দায়ী। বসুন্ধরা গ্রুপের মতো করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরা কতটা জিম্মি- এই ঘটনায় সেটি সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে; কিন্তু সাধারণ মানুষকে এটা বোঝানো সম্ভব নয় যে, সাংবাদিকদের কতগুলো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়।
বস্তুত স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রথম প্রতিপক্ষ- গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিকরা; দ্বিতীয়- বিজ্ঞাপনদাতা বড় বড় প্রতিষ্ঠান; তৃতীয়- সরকার; চতুর্থ- ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল; পঞ্চম- উগ্রবাদী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন; ষষ্ঠ- স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরাসহ প্রভৃতি। কারণ কোনো সংবাদ যখনই এই সব গোষ্ঠীর কোনো একটির বিপক্ষে যায়, তারাই গণমাধ্যমকে শত্রু বিবেচনা করে এবং ব্যবস্থা নিতে উদ্যত হয়। সেটি কখনো বিজ্ঞাপন বন্ধ করে; কখনো সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টার ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে; কখনো রিপোর্টারকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করে; কখনো বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীকে দিয়ে ভয়-ভীতি দেখিয়ে; কখনো মোটা অংকের পয়সা দিয়ে সাংবাদিকদের কিনে নিয়ে, এমনকি কখনো নিবন্ধন বাতিল বা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে।
পৃথিবীর আর কোনো পেশার মানুষকে এতগুলো প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয় না। তার ওপর এই সাংবাদিকদের বিরাট অংশেরই চাকরির নিশ্চয়তা নেই। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি। সুতরাং এতসব সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয় যে গোষ্ঠীকে, তাদের কাছ থেকে সব সময় নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা প্রত্যাশা করা কতটুকু সমীচীন- তাও ভেবে দেখা দরকার।
তবে এতসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণমাধ্যম সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটিই পরিবেশন করবে, মানুষের এটিই প্রত্যাশা; কিন্তু গণমাধ্যম সব সময়ে সেটি পারে না। তাদের সক্ষমতা থাকলেও রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার ও গণমাধ্যমের ভাষা অভিন্ন হয়ে যায়। যেমন- সম্প্রতি ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ইস্যুতে গণমাধ্যম কতটা বস্তুনিষ্ঠ থাকতে পেরেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। গণমাধ্যমের জন্য এটি একটি বিরাট পরীক্ষা যে, সে নিউজ ট্রিটমেন্ট বা সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সব শ্রেণিপেশার নাগরিকের প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারছে কি না? কারণ সরকার ও গণমাধ্যমের ভাষা অভিন্ন হয়ে গেলে, সেখানে জনগণের ভাষা থাকে না। হেফাজতে ইসলাম প্রশ্নে সরকার, সরকারি দল ও গণমাধ্যমের ভাষায় খুব বেশি পার্থক্য দেখা যায়নি। সুতরাং এই ইস্যুতে গণমাধ্যম সরকার ও হেফাজতে ইসলামের মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পেরেছে কি না- সে প্রশ্নও আছে।
আজ বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগ, কাল একইরকম বা আরও গুরুতর অভিযোগ উঠতে পারে অন্য কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তখন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ভূমিকা কী হবে?
বসুন্ধরা গ্রুপের এই ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটি ধারণা করা খুব কঠিন নয়। তবে এর মধ্য দিয়ে আমাদের গণমাধ্যমের জন্য একটা বিরাট এসিড টেস্ট হয়ে গেলো। গণমাধ্যমকে কী ধরনের সীমাবদ্ধতা আর চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়, সাধারণ মানুষকে সেটা বোঝানো কঠিন; কিন্তু নানা কারণেই গণমাধ্যমের প্রতি জনআস্থার যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং পক্ষান্তরে তথ্য জানার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ও নির্ভরশীলতা বাড়ছে, সেটি আরও প্রলম্বিত হবে। তাহলে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ কী?
বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশে ব্যর্থতার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছেন সাংবাদিকরাই। তাই এ নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যেই অসন্তুষ্টি আছে। ভালো সাংবাদিকতা বা জনসাংবাদিকতার যে একটা আকাক্ষা সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছে, এই আকাক্ষাই হয়তো একদিন সাংবাদিকতার সুদিন ফিরিয়ে আনবে।
Leave a Reply