বীরাঙ্গনা সখিনার মর্মস্পর্শী প্রেমের ঘটনা নিশ্চয়ই দেশবাসীর অজানা নয়। বীরাঙ্গনা সখিনার বীরত্বের কথা ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে। সুনসান নীরব পরিবেশে প্রকৃতির নিবিড় মায়ায় চিরঘুমে রয়েছেন বীরাঙ্গনা সখিনা। স্বামীর প্রতি তার মর্মস্পর্শী প্রেমের ঘটনা আজও সবাইকে কাঁদায়।
ডেইলি বাংলাদেশের আজকের প্রতিবেদন বীরাঙ্গনা সখিনা বিবির মর্মস্পর্শী প্রেমের ঘটনাটি নিয়েই সাজানো হয়েছে। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক ইতিহাসের পাতায় লিখে যাওয়া বীরনারী সখিনা বিবির প্রেমের কাহিনি-
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় থেকে ১৩ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত মাওহা ইউনিয়নের কেল্লা তাজপুর গ্রামটি সতের শতকের মুঘল শাসনামলের স্মৃতিবিজড়িত। কেল্লা তাজপুরকে ঘিরে একটি ঐতিহাসিক চমকপ্রদ কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। বার ভূঁইয়ার অন্যতম কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ীর স্বাধীন শাসক ঈসা খাঁর দোহিত্র ফিরোজ খাঁ আর কেল্লা তাজপুরের মুঘল দেওয়ান উমর খাঁর কন্যা সখিনা বিবির স্মৃতিময় গ্রাম। এই গ্রামের কুমড়ী নামক স্থানে ইতিহাসখ্যাত পতিপ্রাণা সখিনা বিবির মাজার নামে একটি ঐতিহাসিক সমাধি সবার নজর কাড়ে।
সমাধির গেটসম্বলিত সীমানাপ্রাচীরমুঘল আমলের বহু স্মৃতি বিজড়িত এ সমাধিস্থলে যেতে প্রথমেই চোখে পড়বে একটি গেটসম্বলিত সীমানাপ্রাচীর। প্রধান ফটকের সীমানাপ্রাচীরে পাথরখণ্ডে লেখা আছে বিবি সখিনার কাহিনি। ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে ইট-সিমেন্টে বাঁধানো সমাধি ও বাঁকানো অনেক গাছ। এর চারপাশে রয়েছে কাঠগোলাপের গাছ। এ গাছের বয়স কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না। দূর থেকে দেখলে অপরূপ লাগে। সমাধিস্থলের পাশেই রয়েছে কয়েকটি চায়ের দোকান। কাহিনি অনুসারে কুমড়ী গ্রাম অনেকের কাছে ‘কেল্লা তাজপুর’ নামেও পরিচিত।
বীরনারী সখিনার প্রেম কাহিনি
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ কেল্লা তাজপুরের মুঘল দেওয়ান উমর খাঁর মেয়ে সখিনা ছিলেন অপরূপ সুন্দরী ও সর্ববিদ্যায় পারদর্শী। তার এই রূপ-গুণের খ্যাতি আশপাশের সর্বত্র অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এমনি ৫০ থেকে ৬০ মাইল দূরবর্তী বারভূঁইয়ার অন্যতম কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ির স্বাধীন শাসক ঈশা খাঁর নাতি ফিরোজ খাঁর কানেও সে খবর পৌঁছে। সেই থেকে অপরূপ সুন্দরী সখিনাকে একপলক দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে ফিরোজ খাঁর অন্তর।
কিন্তু দেওয়ান উমর খাঁ পরিবারের কঠোর পর্দাপ্রথা ফিরোজের ভালোবাসার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে কৌশলের আশ্রয় নেন ফিরোজ খাঁ। দরিয়া নামক এক সুন্দরী নারীকে তসবি বিক্রেতা সাজিয়ে উমর খাঁর অন্তঃপুরে সখিনার বাসগৃহে পাঠানো হয়। দরিয়ার মুখে ফিরোজ খাঁর অসামান্য রূপ-গুণের কথা শুনে সদ্য যৌবন প্রাপ্ত সখিনা নিজের অজান্তেই মন প্রাণ সঁপে দেয় ফিরোজের চরণ তলে।
পাথরখণ্ডে লেখা বীরাঙ্গনা সখিনা বিবির কাহিনীফিরোজ খাঁ জঙ্গলবাড়িতে এসে পরিবারের সম্মতি নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান উমর খাঁর দরবারে। কিন্তু কন্যাপক্ষ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। লজ্জা-ঘৃণা ক্ষোভে ফিরোজ খাঁ বিশাল বাহিনী নিয়ে কেল্লা তাজপুরে অভিযান চালান। অতর্কিত আক্রমণে উমর খাঁর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পরাজয় বরণ করে। শত্রু পক্ষের বিজয়ে উমর খাঁর অন্তঃপুর নারীশূন্য হলেও সখিনার ভাবান্তর হলো না। তিনি ঠায় বসে থাকলেন। বিজয়ী ফিরোজ অন্তঃপুরে ঢুকে তাকে বাহুবন্দি করেন।
এদিকে পরাজিত উমর খাঁ প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ফিরোজ খাঁকে বন্দি করেন। সখিনাকে তালাক দেয়ার জন্য চাপ দেন। কিন্তু ফিরোজ খাঁ তালাক দিতে রাজি হননি। এ সময় হঠাৎ যুদ্ধের ময়দানে হাজির হয় ১৭ থেকে ১৮ বছর বয়সী এক যুবক। তার হাতের ছটায় যেন বিদ্যুৎ লাফায়। ওই যুবকের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় ফিরোজের বিপর্যস্ত বাহিনী। দুর্ধর্ষ আক্রমণে উমর খাঁর বাহিনী বিপন্ন প্রায়।
এসময় কুমন্ত্রণা ছড়ায় যে, ফিরোজ খাঁ সখিনাকে তালাক দিয়েছেন। আলামত হিসেবে ফিরোজের সই জাল করে দেখানো হলো যুদ্ধক্ষেত্রে। মুহূর্তে পাল্টে গেল যুদ্ধের ভাব-গতি। যুবক সেনাপতির মাথা ঘুরছে, দেহ কাঁপছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, ঘোড়ার লাগাম খসে পড়ছে আর তরবারির হাত হয়ে গেছে স্থবির। আস্তে আস্তে টগবগে সেই যুবকের নিথর দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ভূলুণ্ঠিত সেনাপতির শিরোস্ত্রাণ খসে গিয়ে বের হয়ে পড়ে তার আনুলায়িত মেঘবরণ অপূর্ব কেশরাশি। সবাই দেখেন তিনি আর কেউ নন, উমর খাঁর আদুরের দুলালী সখিনা!
বীরনারী সখিনা বিবির সমাধিখবর পেয়ে ছুটে এলেন পিতা। কলিজার টুকরো কন্যার প্রাণহীন দেহ কোলে নিয়ে উন্মাদের মতো বিলাপ করতে লাগলেন। সে ক্রন্দনে জঙ্গলবাড়ীর বাতাস কী পরিমাণ ভারী হচ্ছিল জানা যায়নি, তবে এই কাহিনি শ্রবণে পূর্ববাসীর অন্তর আজও করুণ রসে সিক্ত হয়ে ওঠে। কারো গাল বেয়ে ঝরে কয়েক ফোঁটা নোনাজল। বীরাঙ্গনা নারী সখিনা যে জায়গায় প্রাণত্যাগ করেন সেই কুমড়ী নামক স্থানে গড়ে উঠে তার সমাধি।
শোকে মুহ্যমান উমর খাঁ জামাতা ফিরোজ খাঁকে মুক্ত করে দেন। বন্দি থেকে মুক্ত হয়ে ফিরোজ পাগল প্রায় হয়ে গেলেন। এরপর কেল্লা তাজপুরবাসী দেখে প্রতিদিন সন্ধ্যায় এক দরবেশধারী ব্যক্তি সখিনার সমাধিতে প্রদীপ জ্বেলে নিশ্চুপ বসে থাকেন। দরবেশের বেশধারী ব্যক্তিটি আসলে সখিনার স্বামী ফিরোজ খাঁ।
এখনকার অবস্থা
অতীতে কেল্লাতাজপুর গ্রামের চারপাশে প্রায় চার মাইলব্যাপী মাটির উঁচু প্রাচীর ছিল। সেখানে ঘোড়দৌড় হতো। গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে দুই মাইল বিস্তৃত সুরিয়া নদী। নদীর পাশেই রয়েছে যুদ্ধের পরিখার চিহ্ন। স্থানে স্থানে রয়েছে উঁচু মাটির টিলা। রয়েছে বীরাঙ্গনা সখিনার বাবা কেল্লা তাজপুরের দেওয়ান উমর খাঁর বাড়ির ধ্বংসাবশেষ।
সমাধির চারপাশে কাঠগোলাপ গাছপ্রায় ২০ একর জমিতে অপূর্ব কারুকাজমণ্ডিত বাড়িটি নির্মিত হয়েছিল। গ্রামের মানুষ উমর খাঁর বাড়িকে রাজবাড়ি বলে থাকে। এর পেছনে ছিল হাতি রাখার স্থান, যা গ্রামের মানুষের কাছে পিলখানা হিসেবে পরিচিত। ছিল তাল, মজা, ছিমু রানী, হাসি, মীরা ও কটুর দীঘি নামে বেশ কয়েকটি বিশাল পুকুর। এগুলোর বেশিরভাগই মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। এখনো কেল্লাতাজপুর গ্রামে মাটি খুঁড়লে পাওয়া যায় নানা কারুকার্যময় ইট। অনেক ইটে ফারসি অক্ষরের লেখাও দেখা যায়।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি গৌরীপুরে যাওয়া যায়। এছাড়া ঢাকা থেকে সড়ক পথে ময়মনসিংহে আসতে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে কয়েকটি পরিবহন রয়েছে। ময়মনসিংহ এসে ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের কাছের বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস কিংবা সিএনজি করে গৌরীপুর আসতে পারেন। গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে সিএনজি রিজার্ভ করে কুমড়ী গ্রামে যাওয়া যায়। এছাড়া গৌরীপুর থেকে ভুটিয়ারকোনা বাজারে ইজিবাইকে আসতে পারেন। এরপর রিকশায় যাওয়া যাবে বিবি সখিনার সমাধিস্থলে।
Leave a Reply