অষ্টম হিজরির ঘটনা। নবীজির শেষ গাজওয়া তথা তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে দুর্বল ও অক্ষম ছাড়া সব সাহাবায়ে কেরামই অংশগ্রহণ করেছেন। তবে কয়েকজন সাহাবি বিভিন্ন কারণে পেছনে থেকে যান। তাঁদের একজন কাব ইবনে মালিক (রা.)। এই যুদ্ধ থেকে পেছনে থাকার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তাবুক যুদ্ধ থেকে আমি যখন পেছনে থাকি তখন আমি এত অধিক সুস্থ, শক্তিশালী ও সচ্ছল ছিলাম যে আল্লাহর কসম! আমার কাছে কখনো ইতোপূর্বে কোনো যুদ্ধে একই সঙ্গে দুটো যানবাহন জোগাড় করা সম্ভব হয়নি, যা আমি এ যুদ্ধের সময় জোগাড় করেছিলাম। আর রাসুলুল্লাহ (সা.) যে অভিযান পরিচালনার সংকল্প গ্রহণ করতেন, বাহ্যত তার বিপরীত দেখাতেন। এ যুদ্ধ ছিল ভীষণ উত্তাপের সময়, অতি দূরের যাত্রা, বিশাল মরুভূমি এবং বহু শত্রুসেনার মোকাবেলা করার।
রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং তাঁর সঙ্গী মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে অভিযানে যাত্রার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আমিও প্রতি সকালে তাঁদের সঙ্গে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি। মনে মনে ধারণা করতে থাকি, আমি তো যখন ইচ্ছা পারব। এই দোটানায় আমার সময় কেটে যেতে লাগল। এদিকে সবাই যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হয়ে যায়। আর আমি রওনা করে তাদের সঙ্গে রাস্তায় মিলিত হওয়ার আশায় সময় পার করতে থাকি, কিন্তু তা আমার ভাগ্যে জোটেনি। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) রওনা হওয়ার পর আমি লোকেদের মধ্যে বের হয়ে তাদের মাঝে বিচরণ করতাম। তখন মদিনায় মুনাফিক এবং দুর্বল ও অক্ষম লোক ব্যতীত অন্য কাউকে দেখতে পেতাম না।
এ দৃশ্য দেখে আমার মন অনেক পীড়া দিত যে আমি এখানে আর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাবুকে! এদিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাবুক পৌঁছার আগ পর্যন্ত আমার ব্যাপারে আলোচনা করেননি। কিন্তু তাবুকে এ কথা তিনি লোকেদের মাঝে বসে জিজ্ঞেস করে বসলেন, কাব কী করল? ওই সময় বানু সালামা গোত্রের এক লোক বলল, হে আল্লাহর রাসুল! তাঁর ধন-সম্পদ ও অহংকার তাঁকে আসতে দেয়নি। এ কথা শুনে মুআজ ইবনু জাবাল (রা.) বলেন, তুমি যা বললে তা ঠিক নয়। হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কসম, আমরা তাঁকে উত্তম ব্যক্তি বলে জানি। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) নীরব রইলেন। এই বিষয়গুলো যখন আমি জানতে পারলাম, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় আগমনের অপেক্ষায় থাকলাম।
রাসুলুল্লাহ (সা.) সকালবেলা মদিনায় প্রবেশ করলেন, তখন যারা পশ্চাদপদ ছিল তারা তাঁর কাছে এসে শপথ করে করে অপারগতা ও আপত্তি পেশ করতে লাগল। এদের সংখ্যা আশির অধিক ছিল। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বাহ্যত তাদের ওজর আপত্তি গ্রহণ করলেন, তাদের বায়আত করলেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। কিন্তু তাদের অন্তরের অবস্থা আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিলেন। কাব (রা.) বলেন, আমিও এরপর নবী (সা.)-এর সামনে হাজির হলাম।
আমি যখন তাঁকে সালাম দিলাম তখন তিনি রাগান্বিত চেহারায় মুচকি হাসি হাসলেন। এরপর বলেন, এসো। আমি সে মতে এগিয়ে গিয়ে একেবারে তাঁর সম্মুখে বসে গেলাম। তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী কারণে তুমি অংশগ্রহণ করলে না? তুমি কি যানবাহন ক্রয় করোনি? তখন আমি বললাম, হ্যাঁ, করেছি। আল্লাহর কসম! এ কথা সুনিশ্চিত যে আমি যদি আপনি ছাড়া দুনিয়ার অন্য কোনো ব্যক্তির সামনে বসতাম তাহলে আমি তার অসন্তুষ্টিকে ওজর আপত্তি পেশের মাধ্যমে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করতাম। আর আমি তর্কে পটু। কিন্তু আল্লাহর কসম আমি পরিজ্ঞাত যে আজ যদি আমি আপনার কাছে মিথ্যা কথা বলে আমার প্রতি আপনাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করি তাহলে শিগগির আল্লাহ তাআলা আপনাকে আমার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দিতে পারেন। আর যদি আপনার কাছে সত্য প্রকাশ করি, যাতে আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হন, তবু আমি এতে আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার অবশ্যই আশা করি। না, আল্লাহর কসম, আমার না যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। আল্লাহর কসম! সেই যুদ্ধে আপনার সঙ্গে না যাওয়ার সময় আমি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান ছিলাম। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সে সত্য কথাই বলেছে। তুমি এখন চলে যাও, যত দিন না তোমার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ফায়সালা করে দেন। তাই আমি উঠে চলে গেলাম।
আমার মতো আরো দুই সাহাবি হেলাল ইবনে উমাইয়া ও ওয়াকিফি (রা.) পশ্চাদে অবস্থান করার কোনো ওজর নেই বলে স্বীকার করলেন। আমাদের মসজিদ-ই-নববীর খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হলো। এ অবস্থায় আমরা ৫০ রাত অতিবাহিত করলাম। অবশেষে আল্লাহ তাআলা আমাদের ক্ষমা করার ঘোষণা দেন। আর এই সুসংবাদ রাসুলুল্লাহ (সা.) ফজরের নামাজের সময় সবার সামনে ঘোষণা দেন। উপস্থিত সবাই তখন দাঁড়িয়ে আমাদের ক্ষমা লাভের অভিনন্দন জানান। (বুখারি, হাদিস : ৪৪১৮)
Leave a Reply