বিভিন্ন অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের কাঠগড়ায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (আইইএম) আশরাফুন্নেছা।
কর্মশালা, সেমিনার এবং প্রশিক্ষণের নামে জাল বিল তৈরি করে টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ডা. আশরাফুন্নেছাকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।
যে সব অভিযোগ ডা. আশরাফুন্নেছার বিরুদ্ধে
২০১৮-১৯ অর্থবছরে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম ইউনিট সারাদেশে ৪৮৬টি ওয়ার্কশপ ও সেমিনারের আয়োজন করে। কর্মশালায় ব্যবহারের জন্য কেন্দ্রীয় ভাবে কোন ধরনের টেন্ডার বা কোটেশন ছাড়াই কিছু ব্যাগ, কলম, প্যাড ক্রয় করে আইইএম ইউনিট। তিনটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইইএম পরিচালকের মৌখিক নির্দেশের ভিত্তিতে এসব পণ্য সরবরাহ করে। যেখানে ব্যাগের জন্য ৩৭০ টাকা এবং কলম ও প্যাড যথাক্রমে ১০ ও ২০ টাকা মূল্য নির্ধারন করা হয়।
অথচ বিল ভাউচারে ব্যাগের দাম দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৫০ টাকা, প্যাড ৭০ টাকা এবং কলম ৮০ টাকা। এছাড়া কর্মশালায় রিসোর্স পার্সনদের সম্মানী ভাতা আয়করসহ ১ হাজার ৬৮০ টাকা, স্থানীয় সমন্বয়কারীদের সম্মানী আয়করসহ ১ হাজার টাকা, অংশ্রগহণকারীদের ভাতা বাবদ ৭শ’ টাকা দেখিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে।
এতে অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মানী ভাতা ও যাতায়াত বাবদ ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে সই জাল করে অর্থ তোলা হয়েছে। এভাবে প্রায় ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়। অধিদপ্তরের ‘আইইএম ইউনিট’র খাতে বরাদ্দ ছিল (২০১৯ সালে ) ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এসব টাকার কোনও কাজ না করেই অগ্রণী ব্যাংক, ওয়াসা ভবন শাখা হতে তোলা হয়।
জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৯টি কোটেশনের বিল দেওয়া হয়েছে। যার পরিমাণ ছিল ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ওই বছরে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক ড. আশরাফুন্নেছার ভাগ্নের মালিকানাধীন রূহী এন্টারপ্রাইজ কোনও কাজ না করে ৮৫ লাখ টাকার বিল উত্তোলন করে। কাজ না করেই তার আপন চাচাত ভাইয়ের মালিকানাধীন সুকর্ন এন্টারপ্রাইজকে ১ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। রূহী এন্টারপ্রাইজ ও সুকর্ন এন্টারপ্রাইজের নামে বরাদ্দ ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা উত্তরা ব্যাংকের কাওরান বাজার শাখার মাধ্যমে তোলা হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের কাছে ২০১৮ সালে একটি সচেতনতামূলক ভয়েস ম্যাসেজ প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। যার বাজেট ছিল ৯৯ লাখ টাকা। অধিদপ্তরের তথ্য, শিক্ষা ও উদ্বুদ্ধকরণ (আইইএম) ইউনিটকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ভয়েস মেসেজ প্রস্তুত করে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে তা এক কোটি মানুষের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আইইএম ইউনিট এই কাজের জন্য কবির এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করে। ওই বছরের ৬ এপ্রিল তাদের কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
কার্যাদেশ দেওয়ার পর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো মোবাইল ব্যবহারকারীর কাছে এমন মেসেজ পাঠানো হয়নি। এমনকি কোনো মেসেজ তৈরিই করা হয়নি। তবে ইতোমধ্যে কবির এন্টারপ্রাইজকে পুরো অর্থই পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে।
ডা. আশরাফুন্নেছা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (আইইএম) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৮-১৯ ও ১৯-২০ অর্থ বছরে পরিচালকের (আইইএম) গাড়ি মেরামতের নামে কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
আইইএমের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছরে কোটেশনের মাধ্যমে পিপি আর ২০০৮ এর কোন আইনের তোয়াক্কা না করেই নিজেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এজি অফিস থেকে বিল পাশ করিয়ে আত্মসাত করেছেন প্রায় ৩৪ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর নিয়োগেও ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন ডা. আশরাফুন্নেছা।আইইসি অপারেশনাল প্ল্যানের আওতায় জনবল নিয়োগে তিনি কোন নিয়ম নীতি বা কোটা সংরক্ষণ না করেই অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ প্রদান করেছেন। তিনি আইইসি প্ল্যানের বাংলাদেশ বেতারের জনবল মোটা অংকের টাকা নিয়ে নিজেই নিয়োগ প্রদান করেছেন। কিন্তু অপারেশনাল প্ল্যানে উল্লেখ রয়েছে উক্ত জনবল নিয়োগ প্রদান করতে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালকের অনুমোদন সাপেক্ষে জনসংখ্যা সেলের প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ প্রদান করবেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ডা. আশরাফুন্নেছা সরকারী তিনটি গাড়ী ব্যবহার করছেন পারিবারিক কাজে।
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার শ্যামগঞ্জের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আশরাফুন্নেছা। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের (আইইএম) পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে। আইইএমের পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পর অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
বেলী রোডের মহিলা ক্লাবের পাশে এপার্টমেন্ট প্রজেক্টে ৫ম ও ৮ম তলায় ৩৩০০ স্কোয়ারের ফ্লাট রয়েছে। প্রতিটি ফ্লাটের মূল্য সাড়ে তিন কোটি টাকা। তার ছোট ভাই রানার নামে নিকেতনের ডি ব্লকে ৭নং রোডের ৮/বি প্রজেক্টে কিনেছেন দুইটি বিলাস বহুল ফ্লাট। যার দাম প্রায় ৭ কোটি টাকা। তার আরেক ছোট ভাই মামুনের নামে রয়েছে নিকেতনের ডি ব্লকের ৬ নং রোডের ২৩/এ এপার্টমেন্ট প্রজেক্টে কিনেছেন একটি ফ্ল্যাট যার দাম দেড় কোটি টাকা। ছোট বোনের নামেও দেড় কোটি টাকায় নিকতনে কিনেছেন একটি ফ্ল্যাট।
ছোট ভাই রানার নামে আফতাব নগরে সি ব্লকে কিনেছেন ৮ কাঠা জমি। যার দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা। এছাড়াও আশরাফুন্নেছার নামে বেনামে রয়েছো কোটি কোটি টাকা। যা তিনি কামিয়েছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে।
এই সব নানা অনিয়মের অভিযোগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ডা. আশরাফুন্নেছাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন ডা. আশরাফুন্নেছাকে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জানা গেছে ঐ দিন বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান তিনি।
এ বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (আইইএম) ডা. আশরাফুন্নেছার সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
Leave a Reply