1. iamparves@gmail.com : admin :
  2. hdtariful@gmail.com : Tariful Romun : Tariful Romun
  3. shohagkhan2806@gmail.com : Najmul Hasan : Najmul Hasan
  4. janathatv19@gmail.com : Shohag Khan : Shohag Khan
  5. ranaria666666@gmail.com : Sohel Rana : Sohel Rana
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৪৮ অপরাহ্ন

‘নদীমাতৃক’ শব্দটি কি হারিয়ে যাবে

শফিক হাসান
  • প্রকাশের সময় : শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২০
শফিক হাসান : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

দৃশ্যটি কল্পনা করতে কেমন লাগবে ‘নদীমাতৃক’ বাংলাদেশে কোনো নদীই নেই! বাংলাদেশকে জালের মতো বেষ্টন করে ছিল যে নদী, রেখেছিল পরম মমতার চাদরে ঢেকে, দিয়েছিল ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ অভিধা সেই দৃশ্যকল্প এখন যেন কল্পনার ফানুস হয়ে উঠছে। কোথায় নদী? যেসব নদী এখনো টিকিয়ে রেখেছে অস্তিত্ব— কোনোটিতে পানি নেই; পারাপার হওয়া যায় হেঁটে; ‘বৈশিষ্ট্য’ ধরে রাখা কিছু নদী আবার এত সরু হয়ে গেছে পরিচয় বলে না দিলে আগন্তুক সেটাকে খাল কিংবা নালা হিসেবেই ভেবে নেবে! নদীমাতৃক বাংলাদেশের এমন হাল কাম্য ছিল না। পাল তোলা নৌকাকে পাল গুটিয়ে নিতে হবে, সে পাততাড়ি হবে দীর্ঘস্থায়ী তা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। অথচ সেটাই এখন চরম বাস্তবতা। যে দেশের নদী কথা কইত নারীর মতো, সেই জবাব স্তব্ধ!

টাইম মেশিনে একটু পিছু ফেরা গেলে কেমন দেখা যাবে নদীর চেহারা, বোঝা যাবে নদীবিষয়ক কথকতা!
ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে…। শিল্পীর গানের কথায় মূর্ত হয়ে ওঠে নদী-চরিত্র। আমাদের নদীর কাছে যেতে হবে, নদীর কথা শুনতে হবে, নদীকে জানতে হবে। তবেই হবে নিজেকে জানা, স্বদেশকে জানা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এ গান স্মরণ করিয়ে দেয় নদীর কথা, টেনে নিয়ে যায় নদীর কাছে। নদীর মোহনায় ছুটে যায় মন। নদীপারের খোলা হাওয়া ভরিয়ে দেয় শরীর-মন।

দেশজুড়ে রয়েছে অসংখ্য নদীনালা, খালবিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর, দীঘি, জলাশয় চিনলেই বাংলাদেশকে চেনা হবে। জানতে হবে নদ-নদীর উৎপত্তি ও সর্বশেষ অবস্থা। প্রায় প্রতিটি জেলার ওপর দিয়েই বয়ে গেছে এক বা একাধিক নদী। কথায় বলে, বাংলাদেশ ধানের দেশ, পাটের দেশ আবার নদীরও দেশ! সব নদীর নাম মানুষ তেমনভাবে না জানলেও কিছু কিছু নদীর নাম মুখে মুখে ফেরে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলি, হালদা; ঢাকার বুড়িগঙ্গা; গাজীপুরের তুরাগ; চাঁদপুরের মেঘনা; বরিশালের কীর্তনখোলা, মেঘনা, আডিয়াল খাঁ, তেঁতুলিয়া; সিরাজগঞ্জের যুমনা; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস; যশোরের কপোতাক্ষ নদ; সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা; বগুড়ার করতোয়া; নাটোরের পদ্মা; ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র; বান্দরবানের শঙ্খ বা সাঙ্গু; লক্ষ্মীপুরের মেঘনা; নারাছুগঞ্জের শীতলক্ষ্যা; ঝিনাইদহের চিত্রা; সুনামগঞ্জের কালনী; পিরোজপুরের মধুমতি ইত্যাদি।


ফাস্টবিডিনিউজ পড়তে ক্লিক করুন
WWW.FIRSTBDNEWS.COM
 
ছবি:সংগৃহীত  

আবহাওয়া এবং ঋতু পরিবর্তনের কারণে প্রায় বছরই বাংলাদেশে বন্যা হয়। বন্যা প্লাবিত পানিতে ডুবে যায় বিল, খেত খামার। বন্যায় মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে। আবার এ বন্যার পানিই যখন নেমে যায় তখন অভিশাপ আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয়! পানি দিয়ে যায় বহন করে আনা পলিমাটি, যে পলিমাটিতে বাম্পার ফলন হয়। হাসি ফোটে কৃষকের মুখে। বাংলাদেশিদের জন্য নদী কখনো সর্বনাশা আবার কখনো পরম উপকারী বন্ধু। নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায় অনেকের বাড়িঘর, করালগ্রাসে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসতে হয়। এছাড়াও বন্যায় যখন কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল নষ্ট হয়ে যায় তখন হাহাকারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার কৃষিকাজের জন্য নদীর পানি অপরিহার্য। নদী শুধু সৌন্দর্যের আকর কিংবা যাত্রা-সহায়কই নয়— মাছ, শুঁটকি শামুক-ঝিনুকের জোগানদারও। আমাদের মৎস্য চাহিদার সিংহভাগই পূরণ করে নদী। নদীর ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে জেলে সম্প্রদায়। মৎস্য আহরণ করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী হিসেবেও মৎস্যশিল্পের ভূমিকা কম নয়। রপ্তানিকৃত মাছের মধ্যে ইলিশ ও চিংড়ি প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশের ইলিশ দারুণ জনপ্রিয়। নৌপথে মালামাল আনা-নেওয়ায় নদীর ভূমিকা ব্যাপক। চট্টগ্রাম-খুলনার নৌ বন্দর কর্মচাঞ্চল্যে মুখর থাকে, মালামাল আমদানি রপ্তানির কারণে। বাণিজ্যের বিকাশ হয়েছে তো বটেই নদীকে কেন্দ্র করে বিকাশ লাভ করছে পর্যটনশিল্পও।

এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, টেকনাফের সেন্টমার্টিন, পটুয়াখালীর কুয়াকাটার কথা। এ ছাড়াও বেশকিছু নদীকেন্দ্রিক পর্যটনস্পট রয়েছে। উল্লিখিত তিনটি স্থানে প্রতি বছর দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং বিদেশ থেকেও প্রচুর সংখ্যক পর্যটক এসে থাকে। বিশ্বের সাত সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে কক্সবাজার সমুদ্রও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল (এ তালিকায় সুন্দরবনের নামও ছিল)। গৌরবের এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবগাথা। গর্ব করার মতো কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত আছে। সারা বিশ্বের মানুষ এ খবর জেনে গেছে, কক্সবাজারের নামও স্মৃতিতে স্থান করে নিয়েছে অনেকের।

নদীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। সম্ভাবনা ক্ষেত্রটি ইতোমধ্যে পরিস্ফূটিতও হয়েছে। তবে এটা আরও অনেক বড় ও অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে বলে ধারণা করা হয়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাওয়াই এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত।

মানুষ নদীর কাছে, সমুদ্রের কাছে আশ্রয় পায়, ভরসা পায়। সাহস এবং অনুপ্রেরণার উৎসও নদী-সাগর। তাই তো মানুষ দু’দণ্ড শান্তির প্রত্যাশায় নদীপানে, সাগরাভিমুখে যাত্রা করে। শীতল জলে মন জুড়ায়। শরীর জুড়ায়। উজ্জীবিত হয়ে ওঠে জাদুকরী স্পর্শে। জীবনকে অনুভব করতে শেখে নতুনভাবে। গুণিজনরা বলেন, শিখতে চাইলে নদী-সাগরের কাছে যাও, নদী-সাগরই হচ্ছে সবচেয়ে বড় শিক্ষক।

আমাদের জাতীয় জীবনেও নদী জড়িয়ে আছে নানাভাবে, নানাদিকে। এ থেকে সাহিত্যও বাদ পড়েনি। বাংলা সাহিত্যে নদী বেশ বড় একটা অংশ জুড়ে আছে। সেলুলয়েডের ফিতাও বাদ থাকেনি। নদী, নদীতীরের মানুষ তথা জেলে সম্প্রদায় মূর্ত হয়ে উঠেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি, অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায় বাক্সময় হয়ে ওঠে কপোতাক্ষ নদ, কর্ণফুলি নদী, কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ফুল হয়ে ফুটেছে, আল মাহমুদের কলমে তিতাস নদীর যে বর্ণনা, অনুভূতি তা ছুঁয়ে যায় মানুষের মন। নদী, বর্ষা এসেছে রবীন্দ্রনাথের কলমেও নানারূপে, নানা ভঙ্গিমায়। বন্যা নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি ‘সাহসী’ কবিতা আছে। কবিতাটিতে ফুঠে উঠেছে বন্যার ভিন্ন রূপ-ব্যঞ্জনা।

প্রলয়ঙ্করী, সর্বনাশা বন্যা চিত্রিত হয় এভাবে—
প্রিয় ইন্দিরা, তুমি বিমানের জানালায় বসে,
গুজরাটের বন্যা দেখতে যেও না।
উঁচু থেকে তুমি দেখতে পাও মাইল মাইল শূন্যতা
প্রকৃতির নিয়ম ও নিয়মহীনতার সর্বনাশা মহিমা
নতুন জলের প্রবাহ, তেজী স্রোত— যেন মেঘলা আকাশ উল্টো
হয়ে শুয়ে আছে পৃথিবীতে
মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো বাড়ি, কা-হীন গাছের পল্লবিত মাথা
ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে
বেরিয়ে যেতে পারে, বাহ কী সুন্দর!

বাংলা সাহিত্য ঘাঁটলে এরকম অসংখ্য চিত্র চোখে পড়বে— যা বর্ষা বন্যা নদীকে ভিন্নদৃষ্টিতে দেখার পথ সুগম করে দেবে। ঋত্বিক ঘটক তিতাস একটি নদীর নাম, গৌতম ঘোষ পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের চিত্ররূপ দিয়ে অনবদ্য শিল্প সৃষ্টির নজির স্থাপন করেছেন। তবে সিনেমায় নদীকে বিশদভাবে তুলে ধরার চেষ্টা যিনি করেছেন— চলচ্চিত্রাচার্য আলমগীর কবিরের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়। তার পরিচালিত অনেক চলচ্চিত্র জুড়ে আছে নদী। বাংলা চলচ্চিত্রে সম্ভবত তিনিই নদীকে এনেছেন সবচেয়ে বেশি। ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবিটি ভাবুক দর্শককে নিয়ে যায় নতুন সীমানায়। ঝড়, বন্যা, নদী, সর্বস্ব হারিয়েও টিকে থাকার প্রচণ্ড সংগ্রাম—চিত্রিত হয়েছে তার বহুদর্শী দৃষ্টিতে। তার সিনেমার মূলমন্ত্র ছিল বাংলাদেশ জানতে হলে নদীর কাছে যাও। নদীর কাছে যাওয়ার বিকল্প নেই।

নদী এবং বৃষ্টি; বৃষ্টি এবং বর্ষা একসূত্রে গাঁথা যেন। শৈশবে কে না পড়েছে— আয় বৃষ্টি ঝেঁপে/ ধান দেব মেপে/ লেবুর পাতা করমচা/ যা বৃষ্টি ধরে যা! লোকঐতিহ্য অনুসারে ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে অনাবৃষ্টিতে বৃষ্টি আনা কিংবা গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে বৃষ্টি নামানোর চেষ্টা— বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতিবৃষ্টি এবং অনাবৃষ্টি দুটোই অনাকাঙ্ক্ষিত। বর্ষায় পত্রপুষ্পপল্লবে নতুন করে জেগে ওঠে চেনা প্রকৃতি। প্রিয়জনকে বাদল দিনের প্রথম কদমফুলের উপহার দেওয়ার আবেদনই আলাদা। অনেকের সখ বৃষ্টিতে ভেজা। এটাও রোমান্টিকতার বহিঃপ্রকাশ। প্রিয়জনের সঙ্গে হুডখোলা রিকশায় অথবা খোলা প্রান্তরে হাত ধরে বৃষ্টি ভেজার আনন্দই অন্যরকম।

টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে যে রিমঝিম শব্দের দ্যোতনা তোলে তা মানুষকে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে। এ আনন্দানুভূতি, শ্রবণেন্দ্রিয়ের এ স্বর্গসুধা, মর্মগাথা কেবলই অনুভবের। উপমহাদেশের মানুষ স্বভাবতই একটু বেশি রোমান্টিক; আবেগপ্রবণ ও সৌন্দর্যপ্রিয়। বিশেষ করে বাংলাদেশিদের ভাবুক কবি হিসেবে আলাদা খ্যাতি আছে।

বৃষ্টির রয়েছে দুটি চেহারা। কোমল ও রুদ্র। বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী মানুষ বৃষ্টির রুদ্র রূপের সঙ্গেই বেশি পরিচিত। প্রলয়ঙ্করী ঝড়-বৃষ্টি মুহূর্তেই তছনছ করে দেয় হাজারো মানুষের সাজানো সংসার। বাধ্য হয়ে আবার সবকিছু নতুনভাবে শুরু করতে হয়। সংগ্রামী মানুষের সংগ্রাম চলে নিরন্তর।

নদী, সাগরের সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক ওতপ্রোত। বর্ষাকালে যখন-তখন ঝুপ করে বৃষ্টি নামে। সিংহভাগ মানুষেরই বৃষ্টি নিয়ে ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং বৃষ্টি বিরক্তিকরও বটে। খেটেখাওয়া এবং অফিসগামী মানুসষহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত মানুষের কাছে। জসীম উদদীনের আসমানীদের যেমন ‘একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি’ তেমনি ঢাকা এবং আরও বেশকিছু শহরের রাস্তার অবস্থা করুণ। বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় পথঘাট, গুটিকয়েক ‘অসাধারণ’ মানুষ বাদে সাধারণের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। তাই নগরজীবনে বর্ষা যতটুকু উপভোগ্য তার চেয়ে বেশি বিরক্তিকর। তাই বলে বৃষ্টিকে হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ নেই। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে ‘অবারিত বর্ষণ’ জরুরি।

ফাস্টবিডিনিউজ পড়তে ক্লিক করুন
WWW.FIRSTBDNEWS.COM
 
ছবি:সংগৃহীত 

বর্ষার রূপমাধুরী এবং ঐশর্য উপভোগ করতে গ্রামই সবচেয়ে ভালো। বাংলাদেশের যেমন খালবিল, নদ-নদীর দেশ তেমনি এটি হাওর-বাঁওড়ের দেশ। হাওর-বাঁওড় অনেকের কাছেই অপরিচিত। উত্তরাঞ্চলে মাদারীপুর, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, নড়াইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ইত্যাদি জেলায় রয়েছে বেশকিছু হাওর। এর বাইরে হাওরের অস্তিত্ব খুব একটা নেই। হাওরের আভিধানিক অর্থ— জলময় বিস্তীর্ণ প্রান্তর। মূলত বিলকে কেন্দ্র করে হাওর গড়ে ওঠে। এটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট; কেননা মানুষ হাওর তৈরি করে না। বিল যখন জলমগ্ন হয়ে থাকে বর্ষা কিংবা বন্যার পানিতে, পানির এ আগ্রাসী রূপটিই পরিচিত হাওর হিসেবে। হাওরের আয়ুষ্কাল পাঁচ থেকে ছয় মাস। এ সময়ে ‘বিল’ শব্দটি রূপান্তরিত হয় হাওরে। হাওরে এ সময় সব ধরনের চাষবাস বন্ধ থাকে। হাওর ভরে ওঠে কচুরিপানায়, ফুটে ওঠে শাপলা। শাপলা-শালুক আর শামুক-ঝিনুক প্রাপ্তির নির্ভরযোগ্য স্থান হয়ে ওঠে হাওর। জলমগ্ন হাওরে পাওয়া যায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মলাভ করা অনেক মাছ। তবে কিছু কিছু হাওরে জাল দিয়ে মাছ শিকার করা যায় না। নিচ থেকে জংলার মতো একধরনের গাছ জন্মায়। গাছগুলো প্রকৃত অর্থেই জংলা গাছ, এগুলো কোনো কাজে লাগে না। হাওরের গভীরতা খুব বেশি নয়, মোটামুটি চার থেকে ছয় হাত। জংলা গাছগুলো কখনই পানি ভেদ করে ওপরে ওঠে না, নিচেই ঘাপটি মেরে থাকে!

জলমগ্ন হাওরের রূপ যে না দেখেছে তাকে এর সৌন্দর্য সম্পর্কে বলে বোঝানো কঠিন। নিঝুম নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে জলমগ্ন হাওর থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো দুই একটা বাড়িঘরের উপস্থিতি— অসাধারণ এক দৃশ্য। যখন ঝিরঝির বৃষ্টি ঝরে, হাওর খুবই সুন্দর দেখায়। এ দৃশ্য তৈরি করে সৌন্দর্যের ইন্দ্রজাল। হাওরে নৌভ্রমণ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন মরমি সঙ্গীতসাধক হাসন রাজা। জোছনা রাতে দলবল নিয়ে হাওর ভ্রমণে বের হতেন তিনি। সুনামগঞ্জের অন্যতম এক হাওর— দেখার হাওর। এই দেখার হাওরে বিহার করতেন হাসন রাজা। অনেক সময়ই হাওরে, নৌযানে বসত গানবাজনার আসর। সারা রাত হাওর ভ্রমণ করে ভোরে বাড়ি ফিরতেন। তার হাওর এবং জোছনাপ্রীতি মানুষের মুখে মুখে ফেরে এখনো।

হাওরকেন্দ্রিক পর্যটনও বিকাশ লাভ করতে পারে, পরিকল্পিত উদ্যোগে। বিশাল দীঘিকে বলা যায় হাওরের ক্ষুদ্র সংস্করণ। পার্থক্য হচ্ছে, হাওরের পানি এক সময় নেমে যায় কিন্তু দীঘি ‘দীঘিই’ থেকে যায়। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য দীঘি হচ্ছে— দিনাজপুরের রামসাগর; চট্টগ্রামের জোড়ডেবা (পাহাড়তলী), ভেলুয়াসুন্দরীর দীঘি, আগ্রাবাদ ডেবা; ঠাকুরগাঁওয়ের রামরাই, খুনিয়া; জয়পুরহাটের নান্দাইল দীঘি, আছরাঙ্গা দীঘি, ছোট পাথরঘাটা দীঘি; নীলফামারীর নীলসাগর; কুমিল্লার রামসাগর, বরিশালের দুর্গসাগরসহ বেশকিছু দীঘি রয়েছে। দিনাজপুরের রামসাগর দীঘিকে ঘিরে পর্যটনস্পট গড়ে উঠেছে। একইভাবে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং উদ্যোগ নিলে অন্যান্য দীঘি, অবহেলায় পড়ে থাকা দীঘিও উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারে। বিদেশিদের কথা বাদ দিলেও, দেশের অনেকেই জানে না কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে আমাদের। যা অবহেলায় ও অজত্নে পড়ে আছে।

নদী দখল হয়ে যাচ্ছে, গড়ে উঠছে আবাসন কিংবা বাণিজ্যকেন্দ্র। প্রভাবশালীদের রাজনৈতিক আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে থেকে দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে। সাময়িক লাভের মোহে দেশকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে অনিশ্চয়তার দিকে। মাঝে মাধ্যে নদী বাঁচাও, দেশ বাঁচাও বলে রব উঠলেও তা প্রকৃতপক্ষে কার্যকরী নয়।

একদা বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ঢাকা শহর। তারপর অনেক এগিয়েছে ঢাকা কেবল ‘ঢাকা’ পড়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা এখন অতীত ঐতিহ্য খুইয়ে বিগতযৌবনা এক নদী। এ নদী পৃথিবীর অপরিচ্ছন্ন নদীগুলোর একটি। অসভ্য আমরা উপকারী নদীকে নোংরা করে ফেলছি, কলঙ্কের কালিমা লেপে দিচ্ছি নদীর গায়ে। নানা রকম সীমাবদ্ধতা, অবক্ষয় ভুলে আমরা নদী তীরে দাঁড়াই। বড় করে শ্বাসনিই। সর্পিল গতির নদীতীরে দাঁড়িয়ে মনও চলে যায় কোন সুদূরে; হারায় কোন অজানায়। নিজেদের প্রয়োজনেই বাঁচাতে হবে নদীকে। নদীকে তুলনা করা যায় দেশের ফুসফুসের সঙ্গে; অবহেলার সুযোগ নেই। নদীখেকোদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সময়ের দাবি। জীবনধারা, অর্থনীতি বিকশিত হয়েছে নদীকে কেন্দ্র করে। গড়ে উঠেছে পেশাজীবী। বেদে, জেলেসহ এমন অনেকেরই অস্তিত্ব সংকটে। হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখতে নদী রক্ষার বিকল্প নেই। নদী-মায়ের সব সন্তান নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েনি!

শফিক হাসান : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
shafique_hasan79@yahoo.com

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

নামাজের সময়সূচী

  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৫:০০
  • ১২:২৯
  • ৪:৫৩
  • ৬:৪১
  • ৭:৫৫
  • ৬:১২