আমার ভাষা আমার অহংকার- এই ভাষা শুধু একটি ভাষা নয়। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে আমাদের আবেগ, আমাদের চেতনা। মোটকথা সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশই আমার ভাষা। ভাষা নিয়ে আমার বা আমাদের অনেক অহংকার বা অহংকার করার মতো ইতিহাস রয়েছে। ভাষার জন্য আমরা জীবন দিয়েছি, লড়াই করেছি, বিজয়ও হয়েছে আমাদের। কথায় আছে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা অনেক কঠিন। আসলে আমরা আমাদের কষ্টার্জিত ভাষার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই ভাষার বেহাল অবস্থা। আদতে আজ সত্যিই দুঃখিনী আমার বর্ণমালা। অনেক দুঃখ তার অন্তরে। নিভৃতে নিজের অন্তরে জমা কষ্টে জল ঝরাই।
আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি হলেই শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার জন্য মাতোয়ারা হয়ে যাই। নিজের ফুল আগে দিতে পারলেই হয়তবা ভাষার প্রতি অনেক প্রেমের বহিঃপ্রকাশ হবে বলে মনে করেন কিংবা একটা ফুলের ছবি তুলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেখানোর বাসনায় কাঙ্গাল হয়ে শহীদ মিনারে ফুলের ছবি তোলেন। অবশ্যই নিজের প্রেমিকার কাছে দিয়েও অনেকে বলতে পারেন- দেখো, আমার ভাষার প্রতি কী নিদারুণ ভালোবাসা। তোমার তো নেই! অথচ এই মানুষটাই ভাষাকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করছে এবং ভাষার বিকৃতরূপে অন্যের সঙ্গে কথা বলছে। আবার শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাকে ভুল করে বলার ভালোবাসা দেখিয়ে এলেন। আমরা আজও আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রকাশ ঠিকঠাকভাবে ঘটাতে পারিনি যে কারণে আমাদের ভাষার প্রতি কোনো সত্যিকার ভালোবাসা গড়ে ওঠেনি। আর যা উঠেছে তা মূলত অন্যকে দেখানোর জন্য। সত্যিকার ভালোবাসা যদি আমাদের হৃদয়ের গহিন থেকে উৎসারিত হত তাহলে সত্যিই আমরা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতাম। কারণ ভাষার মাস কোনো দিনক্ষণ ঠিক করে পালন করতাম না, ভাষা আমার প্রতি মুহূর্তের ব্যাপার
ভাষা আমার অহংকার- ভাষাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। এক মাসে কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আমরা ভাষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি এমনকি অন্যকে ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য আহবান করি। পত্র-পত্রিকায় কয়েকটা লেখা বা পত্রিকাগুলো ভাষার মাসে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করার জন্য উন্মুক হয়ে থাকে। কেন না একটা উপলক্ষ পেলেই তো তারা বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন। কিন্তু ভাষা তো আমাদের সর্বমুহূর্তের বিষয়। আমাদের চলনে-বলনে সচেতন হতে হয়।
ভাষাকে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসগুলো ধর্ষণ করে চলেছে তা হচ্ছে এফএম রেডিও কিংবা কিছু চ্যানেল এবং এখন ইউটিউব চ্যানেলগুলো। এরা ভাষাকে বিকৃত করে তা প্রচার করেন আর তাদের নতুন ধাঁচে! ইংরেজি এবং বাংলাকে ককটেল বানিয়ে জনগণকে নিধনের প্রক্রিয়ায় শামিল করেছে। যে ভাষার জন্য একদিন এদেশের ছেলেরা জীবন দিল আজ তারা বেঁচে থাকলে লজ্জায় মুখ লুকাত।
গোপনে নিজেকে নিয়ে আফসোস করত। এমন ভাষার জন্যই তারা জীবন দিয়েছিল? যেকোনো জিনিসই নিজের অন্তর থেকে ধারণ করতে হয় তবেই না তা সুন্দর হয়ে ওঠে। ঘর হতে দু’পা ফেললেই আমরা দেখতে পাই ভুল বানানের ছড়াছড়ি। বিকৃত করে বানান লেখা বা হাজার হাজার বানান ভুল লেখা সাইনবোর্ড, এমনকি সরকারি অফিস-আদালতেও হাজার হাজার ভুল বানানের প্রচলন চোখে পড়ে। আমরা দেখেও না দেখার ভান করে অন্যদিকে পাশ ফিরিয়ে নিই। এই ব্যর্থতা কার বা কাদের। আমরা সবাই দেশকে ভালোবাসি। আমাদের ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল যে মানুষেরা তাদের সম্মান করি না। হয়ত অনেকেই আমার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন তবে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কেননা সত্য বলতে কুণ্ঠাবোধ করি না।
এমনও অনেকে আছেন যারা অহংকার করে বলেন, আমি বাংলা লিখতে পারি না। আমার ছেলে কিংবা মেয়ে বাংলা পড়তে বা লিখতে পারে না। ওরা তো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। যেখানে বিদেশিরা এই মধুর ভাষার স্পর্শে এলে বাংলা ভাষা শেখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সেখানে একজন এই দেশের সন্তান হয়ে বাংলা না জানা নিয়ে অহংকারে ফেটে পড়েন। বাংলা বিষয়ে পড়ালেখার কথা শুনলে আগে মানুষের মনের কুঠিরে ধাক্কা লাগে বাংলা পড়ে কী করবে!
এই আমাদের ভাষাপ্রেম, এই আমাদের অহংকার। এই ভাষাপ্রেম অন্য দেশিদের যেখানে খাঁটি সোনা বানিয়ে তোলে সেখানে আমরা এদেশে জন্মে নিজে কিংবা নিজের সন্তানেরা বাংলা পড়তে বা বলতে পারে না বলে অহংকার করি। তাদের প্রীতি অন্য ভাষার প্রতি। তাদের জন্যই হয়ত মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিম বলেছিলেন- যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
এতে তোমার কোনো অহংকার নেই রে মানুষ; বরং ভেবে দেখ কী হতে চেয়ে কী হারালে। অথচ এই মানুষগুলোকেই দেখা যাবে ভাষা দিবসে বড় বড় ভাষণে। অনেকে আবার ভাষার প্রতি ভালোবাসার জন্য অন্য ভাষার মানুষদের গালিগালাজ করেন। নিজের ভাষাকে ভালোবাসলে সে অন্যের ভাষাকে অসম্মান করতে পারে না। তাই তো নিজের ভাষার প্রতি আগে প্রেমের জন্ম দিতে হবে। এজন্যই তো আগে নিজের ভাষার গাঁথুনি পরে অন্য ভাষার পত্তন। ভাষা নিয়ে কত যে ভাসা ভাসা বিভেদ রয়েছে তা বলা যাবে না।
অনেকে আছেন নিজের মা-মাটির ভাষাকে অস্বীকার করে অন্যের ভাষা অর্থ্যাৎ অ্যারাবিক ভাষাকে তাদের হৃদয়ের ভাষা বলে মনে করেন। কেননা তারা মনে করেন, এই ভাষাতেই আমার কবরে সওয়াল-জবাব হবে। যে কারণে আমাদের আরবি ভাষার প্রতি দরদ থাকতে হবে। কিন্তু নিজের দেশ নিজের মাতৃভাষার প্রতি প্রেম যে কোনো ধর্মেরই মূল কথা কিন্তু আজ আমরা নিজেকে উপেক্ষা করে অন্যেরটা নিয়ে মাতামাতি করি। এটা কোনো দেশপ্রেম হতে পারে না আবার নিজের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমরা অনেককে বলতে শুনেছি বাংলা হিন্দুদের ভাষা আর ইংরেজি ইহুদি-নাছারাদের ভাষা। একমাত্র শক্তিশালী ভাষা আরবি কারণ এটা আমাদের আল্লাহর ভাষা। এমন অনেক কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে তবে এটা কি আমাদের জানা নাই আল্লাহতায়ালা সব ভাষাই বোঝেন। তুমি যে ভাষাতেই তাকে ডাকো না কেন, সেই ভাষাতেই তিনি সাড়া দেবেন।
আমাদের মুখের ভাষা সুন্দর বা সঠিক উচ্চারণে কথা বলাও তো এক ধরনের আর্ট। আমরা সুন্দর করে বাংলা ভাষায় কথা না বলে যত প্রকার পারি নঁঃ এবং ংড় মিশ্রিত ভাষায় কথা বলি আর ভোকালও করে ফেলার চেষ্টা করেছি ইংরেজি বলার অনুকরণে। একসময় একুশে ফেব্রুয়ারি এলে সে রাতে আমাদের চোখে কোনো ঘুম থাকত না। কতিপয় বন্ধু মিলে সারা রাত অন্যের ঘর কিংবা কাঞ্চির কোণ থেকে প্রিয় ফুল চুরি করে ফুলের তোড়া বানিয়ে সবার আগে শহীদের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে আসতাম।
আর এদিকে চুরি যাওয়া ফুলের শোকে ফুলমালিক বা ঐ বাড়ির ছেলে-মেয়ের শখ রাতের আধারে চুরি যাওয়ার জন্য কেঁদে বুক ভাসাত কিংবা হাজার হাজার শাপ-শাপান্ত করে ফুল চোরের গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ত। আজ আমাদের সবার অবস্থায় অনুরূপ হয়ে উঠেছে। শহীদ মিনারে ফুল দিতে হবে, সেলফি তুলতে হবে, দেশবাসীকে দেখাতে হবে! তাতে নিজের ভিতরে ভাষার প্রতি কিংবা ভাষাশহীদদের প্রতি কোনো ভালোবাসা কিংবা প্রেম থাকুক বা না থাকুক। কেউ সুন্দর করে কথা বললে গ্রামাঞ্চলে সাড়া পড়ে যেত- দেখ, দেখ! অমুকের বাড়িতে এক ছেলে-মেয়ে এসেছে- দেখ! কী সুন্দর করে কথা বলে। তার মুখের ভাষা এত মিষ্টি। তার মুখের ভাষা শুনতেই মন চায়।
আদতে আমাদের ভাষা যে মধুর এমন মধুর ভাষা কোথাও গেলে সন্ধান মিলবে না। আজ তো মানুষের সঙ্গে কথায় বলা যায় না। তাদের মুখের ভাষা এত খারাপ। তারা গালি ছাড়া কিছু বলতেই পারেন না। এমনও আছে আমরা সমাজে যাদের আইকন হিসেবে মানতে পারি তাদেরও কিছু ভিডিও দেখলে অবাক হতে হয়- তারা এত খারাপ ভাষায় কথা বলতে পারে? তাহলে আমরা আজ এই ভাষাকে নিয়ে অহংকার করব। না আমরা আমাদের দুঃখিনী ভাষার জন্য শোকসন্তপতা জ্ঞাপন করব।
আমরা যে ভাষার জন্য একদিন লড়েছি, জীবন দিয়েছি সেই ভাষা শুধু একটি ভাষা আন্দোলন ছিল না। সেটা ছিল আমাদের গণতান্ত্রিকতারও বহিঃপ্রকাশ। এখনো এই ভাষার প্রতীক শহীদ মিনার আমাদের গণতান্ত্রিক প্রেরণার একমাত্র প্রতীক। যা আমাদের সকল বাধাকে অতিক্রম করে মধুর ভাষাকে রক্ষা করার শিক্ষা দেয়। আর এজন্যই আমরা অহংকার করি আমাদের বাংলা ভাষাকে নিয়ে। এই ভাষা আমাদের- যেমন কষ্টার্জিত অর্জন তেমনই রক্ষা করাটাও একান্ত দায়িত্ব।
তাই এই ভাষার মাস থেকেই নতুন ভোরের প্রত্যাশায় ফুল শহীদ মিনারে দেওয়ার মাধ্যমেই আরেকবার গর্জে উঠতে হবে। ভাষা ও ভাষাশহীদের যেন সামান্যতম অসম্মান না হয় সে শিক্ষাই সবাইকে নিতে হবে। তবেই না আমাদের সত্যিকার ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া হবে। নতুবা এটা ভণ্ডামি ছাড়া বৈ কিছু না…।
বঙ্গ রাখাল : কবি ও গবেষক
bangorakhal.bd@gmail.com
Leave a Reply