লাভ ম্যারেজ মানে নিজের প্রেমিকাকে বিয়ে, অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে অন্যের প্রেমিকা- বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছিল আবীর। উভয় ক্ষেত্রেই যেহেতু নারীরা ‘প্রেমিকা’, বিয়েতে তাই মুখবুজে সায় দিয়েছিল। যৌথ যাপনের তেত্রিশ দিনের মাথায় জাত চেনাবে শাহানা- বুঝতে পারলে অন্তত তোতলিয়ে কবুল বলত সে। কাজীর সামনে হয়ত ক্ক্ক্ক-ক-ক… করে যেত, বন্ধুরা অভয় দিত- ‘আরে ক! ডরাইস না, আমরা আছি!’
অকূলপাথারে অজ্ঞাত মহাজ্ঞানীর বাণী স্মরণ করতে পারল- কারও সঙ্গে শত্রুতা থাকলে বিয়ে করিয়ে দাও, নতুবা মামলায় জড়াও। অবশ্য কান টানলে মাথা আসে প্রবাদের মতো বিয়ের সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্ক আইন-বিধির! আপাতত তেমন কিছু সরাসরি প্রত্যক্ষ না করলেও দু’হাতে অদৃশ্য কড়া অনুভব করে। দূরদর্শনে দেখাচ্ছিল প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সিনেমা। কাহিনির গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করছিল আবীর। হঠাৎ শাহানা বলে উঠল- ‘চোখ বড় বড় করে কী দেখছ! ওই মেয়েটা কি আমার চেয়ে বেশি রূপবতী?’
কীসের সঙ্গে কী। আবীর উত্তর দিল- ‘ঐশ্বরিয়া রাইকেও ওইদিন ‘মেয়েটা’ বলে টিজ করেছ, আজ আবার প্রিয়াঙ্কাকে। এটা কেমন আচরণ?’
‘মেয়ে না বলে কী বলব, ছেলে?’
‘সম্মানী ব্যক্তিদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা অনুচিত। রবীন্দ্রনাথকে তুমি বলতে পারো না- ছেলেটা ভালো কবিতা লিখেছে।’
‘কী আমার তাত্ত্বিক রে! এখন চলো।’
‘কোথায় যেতে হবে?’
‘নাচনেওয়ালিরা সব ভুলিয়ে দিয়েছে? আজ না মুক্তা আপার বাসায় দাওয়াত!’
বিয়ের পর জগৎ-সংসারের অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছে আবীর। ভুলেছে শাহানার ফুপাত বোনের নিমন্ত্রণের কথাও। কাঁচুমাচু করল- ‘যেতেই হবে?’
শাহানার কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ থাকে না। বাধ্য হয়ে আবীর গাত্রোত্থান করল। রিকশা এগোচ্ছে নারীদের মেকআপ নেওয়ার গতিতে। গরম মেজাজের মধ্যেই দোকানের সাইনবোর্ড থেকে চোখ সরাতে বাধ্য হলো আবীর। শাহানা হিসহিসিয়ে বলল- ‘ওই কালো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কী দেখছ এতক্ষণ?’
‘কালো মেয়ে’র খোঁজে ইতিউতি তাকাল আবীর। কাউকে না পেয়ে বলল, ‘কার কথা বলছ?’
‘এমন ভাব করছ চেনই না! ওই কালো মেয়েও তোমার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল। চখাচখির চোখাচোখি…!’
‘ছি! বর্ণবাদী আচরণ কেন করো! মানুষের গাত্রবর্ণ ধর্তব্যের নাকি!’
‘যদি বলতাম এক সুন্দরী তাকিয়েছিল- তখন?’
মনে মনে হার মানল আবীর। কালো-সাদা আলাদা রং। এক সম্বোধনে যদি আপত্তি না থাকে অন্যটিতে কেন! বিদ্বেষ প্রকাশ না পেলেই হলো। কী আশ্চর্য, সব ভুলে কিছুক্ষণের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠল শাহানা- ‘দেখেছি প্রথমবার/ দু’চোখে প্রেমের জোয়ার…।’ ইতোমধ্যে আবীর বুঝে গেছে বিবাহিতদের নির্ভেজাল প্রেম থাকে না। ঠাট্টাচ্ছলে বলল- ‘আমি তোমার বধূ, তুমি আমার স্বামী… এমন গানে সুর ওঠে না, তাই না?’
‘বউ-জামাই চানাচুর খেতে ভালো লাগে। বউ-জামাইয়ের গান ভালো লাগে না। নিজেকে মহিলা মনে হয়!’
‘এখন আমরা বউ লিখি। আদি শব্দ ব ঔকার বৌ! মানে ব-কে ঘোমটা পরালে বউয়ের দেখা মেলে। আধুনিকতার নামে ঐতিহ্য বিসর্জন…।’
‘নারীদের আর কত দমিয়ে রাখবে তোমরা? আমরা বর্তমানে সর্বত্র নেতৃত্ব দিচ্ছি। এমনকি রিকশাও চালাই।’ যানজট কমেছে। পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল ব্যাটারিচালিত একটি রিকশা। চালক একজন নারী, লক্ষ করেই তুলনাটা টানল শাহানা। বৈমানিকে না গিয়ে তিন চাকায় সীমাবদ্ধ থাকার কারণেই হয় মেজাজ শান্ত। বাতাসটাও মৃদুমন্দ। আবীর বলল, ‘তোমাকে একটা গল্প শোনাই। রকেটগতিতে একটি বই বেস্টসেলার হল। বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোড়ন। লাইনে দাঁড়িয়েও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত বই How can change your wife! পরে জানা গেল বইটির প্রকৃত নাম How can change your life. ব্যবসার কথা চিন্তা করে প্রকাশক খ-এর পরিবর্তে ড ব্যবহার করেছেন!’
শাহানা লাজুক হাসল, ‘যাহ! পুরুষরা বই ছাড়া থাকতে পারে, বউ ছাড়া নয়!’
পরিস্থিতি অনুকূলে। আবীর ফের বলল, ‘কোন পুরুষের কথা বলছ! পুরুষ দুই প্রকার- জীবিত ও বিবাহিত। বিবাহিতদের নিয়ে একবার রাজসভায় ‘ভীতু প্রতিযোগিতা’র আয়োজন হলো। সবাই নিজ নিজ ভীরুতার গল্প শোনাল। একজন লোক সড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এককোণে। মুখ খুলবেই না। স্বয়ং রাজামশাই প্রশ্ন করলে লোকটি বলল, ‘আমার বউ বলেছে তার অনুমতি ছাড়া যেন কথা না বলি!’
যাত্রীদ্বয়কে অবাক করে হেসে উঠল বয়স্ক রিকশাচালক- ‘জব্বর গল্প কইছেন, ছার। তয় আমার বউও এমন- কতা হুনে না। বুঝে কম, বুঝায় বেশি!’
‘থামুন’ বলে তড়াক করে লাফিয়ে নামল শাহানা। ভাড়া পকেটস্থ করতে করতে রিকশাচালক বলল, ‘গাড়ির বেরেক আমার আতে। বউ আবার বেরেক ফেল। সংসারে ট্রাফিক নাই। বুঝবার পারছি, আপনেও আমার মতন মুর্দা-ব্যাডা।’
বাকি পথটুকু হেঁটেই গেল শাহানার মান ভাঙাতে ভাঙাতে। মুক্তা আপাকে দেখে দমে গেল আবীর। পদাধিকারবলে পিচ্চি মেয়েটাকেই ‘আপা’ ডাকতে হবে। বউয়ের বড় বোন বলে কথা! ওয়াশরুমটা চিনিয়ে মুক্তা বলল, ‘টিকা এলেও এখনো করোনা যায়নি। হাত ধুয়ে এসো।’
‘অবশ্যই আপা। আপনি না বললেও যেতাম।’
ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকবে আবীর, ভেসে এল আপার কণ্ঠ- ‘হাবলাটাকে সামলাতে পারছিস তো ঠিকমতো? তোর দুলাভাই প্রথমদিকে বশে থাকতে চায়নি। এখন ভেড়া বানিয়ে ফেলেছি!’
‘পুরুষ হচ্ছে বাঁদরের জাত। সুযোগ দিলে মাথায় ওঠে। একটুও ছাড় দিই না।’
‘তোকে ভালো-টালো বাসে তো!’
‘মালুম হয় না। বোধহয় কোথাও লাইন-টাইন আছে!’
‘তোরও তো ছিল। আহা, বেচারা জহির…!’
সম্মিলিত হাসিতে পর্দা কেঁপে উঠল যেন। পর্দাকাঁপানো নায়িকাদের বয়কট করে ইউটার্ন নিল আবীর।
শনিবার সারাদিন গম্ভীর থাকল শাহানা। আপার বাসা থেকে আবীরের পালিয়ে আসা ভালোভাবে নেয়নি। তার মনাকাশে ঝমলে রোদ উঠল পরদিন- রোববারে। বউবিষয়ক গবেষণায় ইতোমধ্যে জেনেছে আবীর, প্রতি বছর ৩১ জানুয়ারিতে জাপানিরা ‘অদ্ভুত’ একটা দিবস পালন করে। প্রতিপাদ্য ‘বউকে ভালোবাসুন’। ভোরে এলাকাবাসীর ঘুম ভাঙাল সে। চলন্ত রিকশায় মাইকে বলে চলেছে আবীর- ‘প্রিয় গৃহবাসী স্বামীগণ, সংসারে শান্তি চাইলে বউকে ভালোবাসুন। আমার বউ শাহানা ইয়াসমিনকে আমি ভালোবাসি। আপনিও যদি আমার মতো সৎ হন, রাস্তায় নেমে প্রমাণ দিন। মনে রাখবেন, বউ-ই সকল সুখের মূল! প্রিয় দেশবাসী… প্রিয় বিশ্ববাসী…।’
Leave a Reply