মেয়ে হয়ে জন্মেছ যখন শ্বশুরবাড়ি তো যেতেই হবে’—এ কথা শোনেনি এমন মেয়ে নেই। যখনই বুঝতে শিখে মেয়েরা তখন থেকেই এই কথাটা শুনতে হয়। হোক সে ধনী অথবা গরিব। হয়তো শিক্ষিত বা অশিক্ষিত। সব মেয়েকেই এ কথাটা জীবনে বহুবার শুনতে হয় বিয়ের আগ পর্যন্ত।
শ্বশুরবাড়ি নিয়ে মেয়েদের স্বপ্ন থাকে হাজারো। নতুন মানুষটাকে নিয়ে যেমন চিন্তার শেষ থাকে না তেমনি সেখানকার মানুষকে নিয়েও থাকে অজানা ভয়। অজানা রহস্য। জীবনসঙ্গী হিসেবে যে জীবনে আসবে সে কেমন হবে, তা যেমন ভাবায় ঠিক তেমনি ভাবায় শাশুড়ি ‘মা’ কেমন হবেন!
এ ভাবনাটা কেন আসে? কেন আমরা শাশুড়ি বলতে ভয় পাই? কেন বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ হয়? এ যুদ্ধের সূত্রপাত কোথায়? প্রতিটি যুদ্ধেরই একটা না হয় একটা কারণ তো অবশ্যই আছে। জীবনটা তো স্টার প্লাস, স্টার জলসা বা জি-বাংলা না! সেখানে নানা কারণে যুদ্ধ হয় বউ-শাশুড়ির মধ্যে। বাংলা সিনেমাতেও হয় তেমনই! বাস্তবে এ যুদ্ধের সূত্রপাত কিন্তু আমাদের পরিবার এবং নিকটাত্মীয় থেকেই আসে বেশির ভাগ সময়। একটি অবিবাহিত মেয়ের মনে কিন্তু এসব প্রবেশ করিয়ে থাকেন তারাই। দেখা যায়, মেয়েটি বাবার বাড়িতে খুবই মনের সুখে ঘুমাচ্ছে, একটু বেশি বেলা করেই জাগল, তখনই নিজের মা ভালোবেসে বলে বসল ঘুমাও এ বাড়িতে যত খুশি! শ্বশুরবাড়ি গেলে তো পারবে না! শাশুড়ি তখন তোমাকে…! শোনাবে! শখ করে মেয়েটি কোনো একটা রান্না করল পাতিলটা পুড়ে গেল তখন আবার…! তখনই শুনতে হয় শাশুড়ি হলে আজ তোমাকে…শুনতে হতো! মা তো ভালোবেসে বলছে কিন্তু শাশুড়ি সম্পর্কে ভয়টা কিন্তু তখনই ঢুকে যায়। আবার মা যখন মেয়েকে খুব আদরে বড় করে তখন আত্মীয়রা এসে বলে এত আস্কারা দেবেন না, শ্বশুরবাড়ি গেলে কী করবে?
এই যে কথাগুলো মেয়েটার মনে গেঁথে যায় তখন থেকেই শ্বশুরবাড়ি এবং শাশুড়ি মা সম্পর্কে ভয় কাজ করে এবং তা থেকেই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটা যতই সুখে থাকুক মনে যেন তৃপ্তি আসে না, মনে হয় যেন আমার মা হলে তা বলত না, এমনটা করত না। কারণ, মা তো বলেছিল শাশুড়ি এমনই আমরা মানতে পারি না তাদের আপন করে। সামান্য ব্যাপারটাকেও অনেক বড় কারণ বলে মনে হয় তখন!
আর শাশুড়িদের মনেও কিন্তু ভয়টা ঢুকে যায় ছেলেটা বড় হওয়ার পর থেকেই। উনাদের শোনানো হয় নানা রকম কথা। সুখ করে নিন বউ আসলে তো পারবেন না! সংসারের চাবি থাকবে বউয়ের হাতে! মা-ছেলের খুবই একান্ত ভালোবাসার সময় কেউ একজন এসে বলবে যে, বিয়ে দিন! তারপর তো ছেলেটা এমন থাকবে না দেখবেন কিন্তু! এই যে কিন্তুটা এটাই তো শাশুড়ির বউ সম্পর্কে ভয়ের কারণ। বউ ঘরে আসলে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা পরিবর্তন তো ছেলেদের মাঝে আসেই। তখন ঐ ব্যাপারটাকেই শাশুড়িদের মেনে নিতে কষ্ট হয়। মনে করে ছেলে না জানি পর হয়ে গেল কি না লোকে যে বলেছে তাই তো ঠিক!
আমি বুঝতে পারি না এ সংসারের চাবির মাঝে কী এমন জিনিস আছে! আবার ছেলেও যখন মাকে ভালোবাসে বউয়ের কষ্ট পাওয়ার কী আছে? বউকে সময় দিলে শাশুড়ি কষ্ট পাওয়ার কী আছে? উনিও তো কারো ছেলেকে জীবনসাথী করে নিয়েছেন!
আরেকটা বিষয় খেয়াল করা যায় যে শাশুড়িরা বউদের বলে থাকেন আমি আমার শ্বশুরবাড়িতে থাকতে এমনটা করেছি তুমি কেন পারবে না? তোমার মা কী কিছুই শেখাননি? এই যে কথাগুলো এগুলো যে কতটা কষ্টদায়ক তা কেবল সেই মেয়েটি বুঝবে যে কি না এসব শুনে এসেছে। আমি যখন শুনেছি তা আমার ছেলের বউকেও শুনাব এই মানুষিকতাটা অবশ্যই পালটানো উচিত। এমনটা কি কখনো হতে পারে না, যেখানে শাশুড়ি শুধুই মা হবেন। এমনটা কি হতে পারে না, বউ না হয়ে মেয়ে হবে সেই সংসারের। এমনটা কি মনে করা উচিত না, যে এই মেয়েটি তার সবচেয়ে আপন বাবা, মা, ভাইবোনকে ছেড়ে এসেছে। তবে এই যুদ্ধের জাঁতাকলে পড়ে ছেলেটির অবস্থা সবচাইতে যে বেশি খারাপ হয়। মানসিক অশান্তিতে থাকতে থাকতে সে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। মা ও বউ দুজনের কাকে সে সাপোর্ট করবে? একটা সময় মনে করতাম শিক্ষিত বউ-শাশুড়ি হলে এমনটা আর হবে না তবে তা ভুল, শিক্ষিতদের মাঝেও এমনটা অহরহ ঘটছে। এটা একধরনের মানসিক রোগও বলা চলে। কেউ যেন কাউকে মেনে নিতে পারেন না স্বাভাবিকভাবে। একটা সময় মনে হয়, আমি চাইলেও বউয়ের মনের মতো হব না, বউও হবে না! যুদ্ধের সূত্রপাত যে বহু পুরোনো। পালটানো তো যাবে না।
নতুন প্রজন্মের কাছে এতটুকু আশা করা যায় যে এখনই সময় নিজেকে পালটানোর নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটানোর। বউ ও শাশুড়ি একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং একে অন্যের পুরিপূরক। এটা মনে করে চলুন, সূত্রটা না হয় এবার পালটাই!
লেখক :সাবেক শিক্ষার্থী, নোয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজ
Leave a Reply