দুনিয়ার যেখানেই কোনো মুসলিম রয়েছে, তাদের সবার প্রতি আমাদের অভিনন্দন যে আল্লাহ পুনরায় রমজানের সৌভাগ্য দান করেছেন। যদি তিনি রমজানের আগে আমাদের উঠিয়ে নিতেন অথবা যদি আমাদের অসুস্থ করে দিতেন, যদি অক্ষম করে দিতেন, তাহলে তো আমরা রমজানের সুফল ও স্বাদ পেতাম না, রমজান দ্বারা উপকৃত হতে পারতাম না। আল্লাহর অনুগ্রহ তিনি ঈমান ও ইসলামের সঙ্গে, সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায়, নিরাপদ ও নিশ্চয়তার মধ্যে রোজা অতিবাহিত করার সুযোগ দান করেছেন। রমজানের শুরুতে আমরা আনন্দ প্রকাশ করেছি এবং পরস্পরকে অভিনন্দন জানিয়েছি। এখন এমন সময় এসেছে, যখন আমরা পরস্পরকে সান্ত্বনা দেব এবং ধৈর্য ধারণে উৎসাহিত করব। কেননা রমজান আমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছে।
দুঃখের বিষয় হলো, বেশির ভাগ মানুষের ভেতর এই অনুভূতি নেই যে রমজান বিদায় নিচ্ছে, কী অমূল্য সময় জীবন থেকে বিদায় নিচ্ছে। রমজান আবারও আসবে। যত দিন আল্লাহর ইচ্ছা—তিনি পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখেন রমজান আসবে, প্রতিবছরই আসবে, যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে আসবে, রোজাদাররা রোজা রাখবে, মুসল্লিরা মসজিদ আবাদ করবে; কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা থাকব কি না? আর যদিও থাকি, তবে কী অবস্থায় থাকব?
সুতরাং এ বছর আল্লাহ যে রমজান দান করেছিলেন তাঁর একান্ত অনুগ্রহ ছিল। এ অনুগ্রহ লাভে আমরা যেমন আনন্দিত হয়েছিলাম, তেমনি তার বিদায়ে ব্যথিত হব। তবে তাকে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেব না। বর্তমানে কোথাও কোথাও ধুমধামের সঙ্গে রমজানকে বিদায় জানানো হয়। ‘জুমাতুল বিদা’ (রমজানের শেষ জুমা) কেন্দ্রিক আয়োজন তার একটি দৃষ্টান্ত। এসব আনুষ্ঠানিকতা রমজানের মৌলিক শিক্ষার পরিপন্থী। রমজানের শিক্ষা হলো যতটুকু সময় মেলে একান্তে আল্লাহর ইবাদত করবে, মসজিদে অবস্থান করবে, আল্লাহর জিকিরে মগ্ন থাকবে, রমজানের যে সামান্য সময় অবশিষ্ট আছে, তাতে কোরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর দরবারে অশ্রু বিসর্জন করবে। ইবাদত, জিকির ও চোখের পানি যেহেতু আল্লাহর জন্য, তাই মানুষ-দেখানো আয়োজন নিষ্প্রয়োজন। শোকযাত্রা ও বড় আয়োজনে রমজানকে বিদায় জানানোর মধ্যে, এমনকি হাজারবার ‘বিদায়’ শব্দ উচ্চারণেও কোনো উপকার নেই। বুদ্ধিমানের কাজ হলো—অতীতের সময়ের সদ্ব্যবহার হলে আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা আদায় করা, সদ্ব্যবহার করতে না পারলে লজ্জিত-ব্যথিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং যতটুকু সময় অবশিষ্ট আছে তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা। লজ্জা ও তাওবা বান্দার কাজের অপূর্ণতা দূর করে এবং আল্লাহর নৈকট্য দান করে।
মানুষ যত বেশি মূল্যবান জিনিস হাতছাড়া করে, তত বেশি ব্যথিত হয় এবং তা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে। আর তা হারিয়ে না গেলে সংরক্ষণের সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এখন ভেবে দেখতে হবে, রোজা ও রমজানের সঙ্গে আমরা কেমন আচরণ করেছি এবং কিভাবেই তা তাকে বিদায় জানাচ্ছি। অন্তর সাক্ষ্য দেবে—রমজানের কোনো অধিকার আমরা আদায় করতে পারিনি, আমরা নিজেরাও রমজানের জন্য যোগ্য ছিলাম না, তার পরও আল্লাহ যখন নিজ অনুগ্রহে আমাদের তা দান করলেন আমরা তার যথাযথ মূল্যায়ন করিনি।
যদি কোনো বাদশাহ আপনার কাছে আসেন এবং আপনি তাঁর আপ্যায়ন করেন। আর যাওয়ার সময় তাঁকে বলেন—আপনার কি চমৎকার আপ্যায়নই না করলাম, এমন আপ্যায়ন আপনি কোথায় পাবেন? তাহলে বাদশাহ অপমান বোধ করবেন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে শাস্তিও দিতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি আপনার অপূর্ণতার কথা স্বীকার করেন এবং অপারগতা প্রকাশ করেন, তবে তিনি খুশি হয়ে আপনাকে পুরস্কৃত করবেন। রমজান মুমিনের জন্য বাদশাহর চেয়েও সম্মানিত অতিথি। সে এসেছিল এবং এখন বিদায় নিচ্ছে। রোজার ব্যাপারে রাজাধিরাজ মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘রোজা আমার জন্য এবং আমি নিজে তার প্রতিদান দিই।’ সে মহিমান্বিত রোজা আমাদের ঘরে এসেছিল। এসে সে কী পেয়েছে? তার কি আদর-আপ্যায়ন হয়েছে? না আমরা ঠিকমতো রোজা রেখেছি, না আমরা নামাজ আদায় করেছি। কতটা অমনোযোগ নিয়ে তিলাওয়াত করেছি! আমরা গোপনে আল্লাহর বান্দাদের কোনো সাহায্য করেছি? অসহায় ও ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দিয়েছি? প্রতিবেশীরা যেন নিরুদ্বেগে রোজা রাখতে পারে সে চিন্তা কখনো এসেছে মাথায়? মূলত আমরা এমন কিছুই করতে পারিনি, যা আল্লাহর দরবারে উপস্থাপন করা যায়, যা দেখে মহান আল্লাহ খুশি হবেন। হাদিসে এসেছে, আল্লাহ ভগ্নহৃদয় মানুষের কাছে থাকেন। মানুষ ফরিয়াদ করবে, হে প্রতিপালক! আমরা আপনাকে কোথায় খুঁজব? আমরা দরিদ্র, আমাদের মাটি দ্বারা তৈরি করা হয়েছে, আমরা অপবিত্র। অন্যদিকে আপনি মহান, আপনাকে কোথায় খুঁজে পাব? আল্লাহ বলবেন, আমাকে অনুসন্ধান করতে হলে ভগ্নহৃদয় মানুষের কাছে করো, ব্যথিতপ্রাণ মানুষের কাছে যাও।
যেহেতু আমরা রোজার অধিকার আদায় করিনি, আল্লাহর দরবারে পেশ করার মতো ইবাদতও করতে পারিনি, তাই যে সামান্য সময়টুকু আছে, তা তাওবা ও ইস্তিগফারে অতিবাহিত করব। আমাদের করা সামান্য ত্রুটিপূর্ণ ইবাদতগুলো যেন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে কবুল করে নেন সেই প্রার্থনা করব।
সামনে ঈদ। ঈদের আনন্দ তাদের জন্য, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশনা মতে রোজা অতিবাহিত করতে পেরেছে। কিন্তু যে রমজানের হক আদায় করেনি, তার জন্য আনন্দ কোথায়? সে নিজের অবহেলা, অমনোযোগ ও অপূর্ণতার জন্য মনস্তাপে পুড়বে। বহু মানুষ রোজা রাখে না কিন্তু ঈদের আনন্দ উৎসবের সঙ্গে পালন করে। আর কিছু মানুষ ঈদের আনন্দ উদযাপন করতে গিয়ে রমজানের সব সংযম বিসর্জন দিয়ে দেয়। তারা ভুলে যায় আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা খাও, পান করো; কিন্তু অপচয় কোরো না।’
তামিরে হায়াত থেকে আতাউর রহমান খসরুর ভাষান্তর
Leave a Reply