করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন দেশীয় উৎপাদকরা। বিপুল চাহিদার বিপরীতে অক্সিজেনের পর্যাপ্ত জোগান না থাকায় চিন্তিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ওদিকে ভারতে করোনা মহামারি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় অভ্যন্তরীণ সংকট মেটাতে দেশটি অক্সিজেন রপ্তানি স্থগিত করে দিয়েছে। এ অবস্থায় এখনই বিকল্প প্রস্তুতি না নিলে অক্সিজেন সংকট ভারতের মতো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে চারটি প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন তৈরি করে। এগুলো হচ্ছে লিন্ডে বাংলাদেশ, স্পেক্ট্রা অক্সিজেন, ইসলাম অক্সিজেন ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাসেজ। করোনা মহামারির আগে দেশে দৈনিক ১০০ টন মেডিক্যাল গ্রেড অক্সিজেনের চাহিদা ছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেই চাহিদা বেড়ে ২০০ টন ছাড়িয়ে গেছে। এই চাহিদা আরো বাড়তে পারে।
সূত্র জানায়, দেশের বড় বড় হাসপাতালে প্রতিদিন সরবরাহকৃত ৫০ শতাংশের বেশি তরল অক্সিজেন সরবরাহ করে লিন্ডে বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে দিনে ৯০ টন অক্সিজেন সরবরাহ করছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৫ টন সরবরাহ দিচ্ছে স্পেক্ট্রা অক্সিজেন। ইসলাম অক্সিজেনসহ অন্যরা বাকিটা সরবরাহ করছে।
বর্তমানে ২০০ টনের বেশি চাহিদার বিপরীতে ১৩৫ টনের মতো জোগান মিলছে। কিন্তু ভারত থেকে সম্প্রতি লিন্ডে বাংলাদেশ ও স্পেক্ট্রার অক্সিজেন আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ৮০ টনের বেশি জোগান কমে গেছে। এ অবস্থায় এখনই বিকল্প না ভাবলে করোনা পরিস্থিতি আরো বেড়ে গেলে বিপদ নেমে আসতে পারে।
বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালের পরিচালক (জনসংযোগ) ডা. সাগুফতা আনোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অক্সিজেনের ব্যবহার আগের তুলনায় বেড়েছে। আমাদের হাসপাতালে স্বাভাবিকের চেয়ে চার গুণ বেড়েছে অক্সিজেনের চাহিদা। তবে এখনো সরবরাহ সংকট হয়নি।’
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে লিন্ডে বাংলাদেশের কারখানায় অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন উৎপাদন হয়। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর এই প্লান্টে কম্প্রেসরের মোটর পুড়ে গিয়ে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় ভারতের ঝাড়খণ্ডে তাদের কারখানা থেকে প্রতিদিন ১০টি ট্যাংকারে ৮০ টন করে তরল অক্সিজেন দেশে আনত তারা। অন্যদিকে চট্টগ্রামের প্লান্ট যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
লিন্ডে বাংলাদেশের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক সায়কা মাজেদ গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত ১১ ডিসেম্বর আমাদের রূপগঞ্জ কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরে নতুন মোটর এনে সেটি চালু করেছি। ভারতে আমাদের আরেকটি কারখানা আছে। করোনায় বাড়তি চাহিদা পূরণে সেখান থেকে অক্সিজেন আনা হচ্ছিল। কিন্তু ভারত থেকে পাঁচ দিন ধরে অক্সিজেন আসছে না। শুনেছি ভারত সরকার সব প্লান্ট অপারেটরকে রপ্তানি স্থগিত রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। এ অবস্থায় আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে সরবরাহ কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের কাছে দিনে ১২০ টনের বেশি চাহিদা আছে। আমরা উৎপাদন করছি ৯০ টন।’
স্পেক্ট্রা প্রতিদিন ৪৫ টন অক্সিজেন সরবরাহ করছে। তারা স্থানীয়ভাবে ২০ টন এবং ভারত থেকে ২৫ টন আমদানি করত। কিন্তু ভারত থেকে লিকুইড অক্সিজেন আনা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা প্রকৌশলী খলিলুর রহমান বলেন, ‘যেকোনো সময়ের তুলনায় মেডিক্যালে অক্সিজেনের চাহিদা এখন সবচেয়ে বেশি। আমার ধারণা, এই মুহূর্তে দিনে ২০০ টনের বেশি অক্সিজেন লাগছে। ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করে আমরা এই মুহূর্তে দিনে ৪৫ টন অক্সিজেন সরবরাহ করছি। সর্বোচ্চ সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আমরা চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছি। কিন্তু হঠাৎ চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে গেলে আমাদের পক্ষে রাতারাতি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, ‘সাধারণ সময়ের চেয়ে করোনায় মেডিক্যাল অক্সিজেনের চাহিদা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। দেশে দুটি কম্পানি (লিন্ডে ও স্পেক্ট্রা) দিনে ১৬০ টনের মতো তরল অক্সিজেন সরবরাহ করছে। কিন্তু ভারত থেকে তারা যে পরিমাণ আমদানি করত ওইটুকু ঘাটতি রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশীয় ছোট ছোট কম্পানিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। বিদ্যমান কম্পানিগুলো এবং নতুনদের মাধ্যমে কিভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা আমাদের আছে।’
সূত্র জানায়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নতুন উৎস খুঁজতে শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নতুন উৎস হিসেবে যে তিনটি কম্পানির সঙ্গে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে, তাদের একটি হলো আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির সীতাকুণ্ডের প্লান্টে দৈনিক মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৫০ টন। তবে তরলীকৃত অক্সিজেন উৎপাদনের ক্ষমতা মাত্র ১৫ টন। প্রতিষ্ঠানটি মেডিক্যাল গ্রেড অক্সিজেন বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তবে কভিড পরিস্থিতি বিবেচনা করে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর তাদের সাময়িক অনুমোদন দিয়েছে।
Leave a Reply