দেশসেরা স্বীকৃতি পাওয়া ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতাল ডুবাতে উঠেপড়ে লেগেছে কর্মচারীরা। যে যেভাবে পারছেন পকেট ভারী করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সেবার নামে দাবি করা হচ্ছে টাকা। এটিকে অনেক কর্মচারী নাম দিয়েছেন বকশিস। এসব কর্মচারীদের তালিকা তৈরি করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
এক হাজার শয্যার এই হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া পাঁচ থেকে ছয় হাজার রোগী আউটডোরে চিকিৎসাসেবা পেয়ে থাকেন। শয্যার তুলনায় কয়েকগুণ রোগী থাকায় সেবার নামে বাড়তি টাকা নেয়ার জন্য ওঁত থাকেন অসাধু কর্মচারীরা। নির্দিষ্ট সেবা দেওয়ার পর বকশিসের নামে চাহিদামতো টাকা না দিলে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। পরেরবার কোনো সেবা পেতে চাইলে নানা অজুহাতে সেবা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। চক্ষুলজ্জা কিংবা হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নালিশ করা হতে পারে, এমন ভয়ে অসাধু কর্মচারীদের অনেকে খিটখিটে মেজাজে লোক দেখানো সেবা দিয়ে থাকেন। এতে ক্ষুব্ধ রোগী ও স্বজনরা।
কর্মচারীদের অনিয়মসহ খামখেয়ালিপনা আচরণ নিয়ে অসন্তোষ হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। মাঝেমধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগও দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নজির খুব বেশি নেই। রোগী ও তাদের স্বজনদের বিচারের আশ্বাস দিয়েই ক্ষান্ত কর্তৃপক্ষ। তবে সম্প্রতি আবারো কর্মচারীদের আচরণ আলোচনায় আসলে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে হাসপাতাল প্রশাসন।
গত ২৮ অক্টোবর রাত দেড়টার দিকে হাসপাতালের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত ট্রলিবয় রূহান হোসেন রূপু একজন রোগী নিয়ে ওই ওয়ার্ডে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে চিৎকার করেন। এ সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত এক রোগী লাইট জ্বালাতে নিষেধ করলে ট্রলিবয় রূপু আহত রোগীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেন। একপর্যায়ে রূপু অন্য ট্রলিবয়দের ডেকে এনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন সোহেল, সাগর, হৃদয়, শামীম এবং নাজমুল নামে পাঁচজনকে মারধর করেন। মারধরের ঘটনায় ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ সময় ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক সেনাবাহিনী, জেলা পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, মহানগর ও জেলা ছাত্রদলসহ ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
এদিকে এ ঘটনায় ওয়ার্ড মাস্টার মো. শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে চারজনের নাম উল্লেখ করে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাত আরো ৪ থেকে ৫ জনকে আসামি করা হয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত রূহান হোসেন রূপু এবং মোশারফ হোসেনকে সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সেবার মান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি, গুড গভর্নেন্স, চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক, টিকিট কাটা থেকে সেবা পাওয়া পর্যন্ত রোগীর কত সময় লাগে- এরকম কয়েকটি ক্রাইটেরিয়ায় ৩০০ নম্বরের মধ্যে স্কোরিং করে সেরা প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করা হয়। ফিল্ড ভিজিট এবং রোগীর সাক্ষাৎকারও এই ফলাফলের মূল্যায়নে অন্তর্ভুক্ত হয়। মমেক হাসপাতালটি এসব কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার ফলেই দেশসেরা হাসপাতালের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে হাসপাতালের সেবা নিয়ে অসন্তুষ্ট রোগীরা। অসাধু কর্মচারীদের দাপটের কাছে জিম্মি তারা। ফলে হাসপাতালের সুনাম ধরে রাখতে অসাধু কর্মচারীদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি রোগীদের।
তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বৃহত্তর ময়মনসিংহের দুই কোটি মানুষের ভরসাস্থল এই হাসপাতাল। এছাড়া গাজীপুর ও সুনামগঞ্জ জেলার মানুষও চিকিৎসা নিতে এই হাসপাতালে আসেন। এক হাজার শয্যার অনুমোদিত লোকবল দিয়ে বাড়তি এসব রোগীর চাপ সামাল দিতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা। তারপরও চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। রোগী ও তাদের স্বজনদের হয়রানি কিংবা সেবার নামে বাড়তি টাকা নেয়ার কোনো অভিযোগ আসলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কারও কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রোগী ও স্বজনরা জানান, হাসপাতালে ব্যাপক দাপট কর্মচারীদের। বিশেষ করে আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত কর্মচারীদের সঙ্গে এক কথা দুইবার বলার সাহসও পাওয়া যায় না। তাদের বেশিরভাগ স্থানীয় হওয়ায় বেশি প্রভাব খাটায়। ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন গ্রাম থেকে আসা রোগীরা। আউটসোর্সিং ছাড়াও অসাধু কিছু স্থায়ীও কর্মচারীও সেবা দেওয়ার পর বকশিস দাবি করেন। বকশিস না দিলে রোগী ও তাদের স্বজনদের দিকে থাকে ভ্রু কুঁচকানো চোখ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব দিকে সুদৃষ্টি দিলে বাড়বে সেবার মান।
সদরের চুরখাই এলাকার বয়োবৃদ্ধ মঞ্জু মিয়া পেটে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া নিয়ে হাসপাতালে আসেন। হেঁটে যেতে খুব কষ্ট হয় তার। সঙ্গে ছিলেন অটোচালক ছেলে আলমাস। ট্রলিবয়কে ডেকে বলেন- ট্রলিতে করে তার বাবাকে ওয়ার্ডে নিতে হবে। আলমাসকে বলে দেড়শ টাকা লাগবে।
আলমাস ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, তাড়াহুড়ো করে আব্বাকে হাসপাতালে আনছি। লগে যা টাকা আছিন, গাড়ি ভাড়ায় খরচ হয়ে গেছে। হাসপাতালে আইবার পরে লগে টাকা আছিন না। এজন্য ট্রলিবয়কে টাকা দিবার পারছি না। নিজেই আব্বারে ধইরা ধীরে ধীরে ওয়ার্ডে নিয়ে গেছি।
ইদ্রিস আলী নামে আরেকজন বলেন, জেলার ফুলপুরের বালিয়া গ্রাম থেকে এসে এক সপ্তাহ ধরে শিশু ওয়ার্ডের মেঝেতে বাচ্চাকে নিয়ে ভর্তি আছি। চিকিৎসক না থাকলে নার্সদের সহযোগিতা নিচ্ছি। নার্সদের ডাক দিলে শিশুর কাছে আসেন অনেকক্ষণ পরে। পরেরবার আবারো ডাক দিলে রাগ করেন। এক কর্মচারী বেসরকারি হাসপাতালে চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তার কথায় যাইনি। চিকিৎসক শিশুকে হাসপাতালে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লিখে দিয়েছিল। ওই কর্মচারী নিজ থেকেই আরেকজন লোকের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট পেয়েছি। এজন্য কর্মচারীসহ আরেকজনকে ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের একজন নার্স বলেন, এই ওয়ার্ডে এখন শিশু রোগীর চাপ আরো বেড়েছে। তবুও আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। মাঝেমধ্যে অনেকজন শিশুদের অনেকজন অভিভাবক কিংবা স্বজন একসঙ্গে এসে ডাকাডাকি করেন। তখন প্রথমে একজন অসুস্থ শিশুর কাছে গিয়ে পরে আরেক শিশুকে সেবা দেওয়া হয়। মাঝেমধ্যেই শিশুর অভিভাবক রাগারাগি করলেও আমরা চুপ থাকতে চেষ্টা করি।
বাড়তি টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে সালাম নামে এক কর্মচারী বলেন, আমি কখনো কারও কাছ থেকে টাকা নেই না। অন্য কর্মচারী এসব করে কি-না; আমার জানা নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ময়মনসিংহের সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা ভালো রাখতে চাইলে হাসপাতালকে অনিয়ম ও দুনীতিমুক্ত করতে হবে। হাসপাতালের কারও বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে চাকুরিচ্যুতসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে অনিয়ম করা অন্যরা ভালো হবে না।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন বলেন, স্বাস্থ্যসেবার মান ভালো রাখতে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে। গুটি কয়েক কর্মচারীর জন্য সুনাম নষ্ট হতে দেওয়া হবে না। কোনো কর্মচারী কোনো অনিয়ম করলে কিংবা বাড়তি টাকা নিলে সচেতন রোগী কিংবা তাদের স্বজনদের উচিত আমাদের জানানো। তাহলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে আমাদের সুবিধা হয়। তবে কর্মচারীদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। অনিয়মের প্রমাণ মিললে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Leave a Reply