ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় লাগেজ থেকে এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় প্রায় ২মাস পর হত্যা রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (পিবিআই)। গত ৯ নভেম্বর সোমবার সকালে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে গঙ্গাশ্রম এলাকায় ব্রিজের কাছে খয়েরি রঙের একটি লাগেজ থেকে ওই তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
শুক্রবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস জানান, গত ০৯/১১/২০২০ খ্রিঃ সকাল ০৭.৪৫ ঘটিকার সময় গৌরীপুরের গঙ্গাশ্রম গ্রামের জোড়া ব্রিজের নীচে সন্দেহজনক একটি লাগেজ পাওয়া যায়। খবর পেয়ে গৌরীপুর থানা পুলিশ, সিআইডি ও পিবিআই দ্রুত ঘটনাস্থলে যায়।
এরই মাঝে থানা পুলিশ তাদের প্রাথমিক আইনানুগ কার্যক্রম শেষ করেন। অজ্ঞাতনামা মহিলার মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্য প্রেরণ করেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ মর্গে। অজ্ঞাতনামা আসামী করে গৌরীপুর থানার মামলা নং-০৮, তারিখ-০৯/১১/২০২০ খ্রিঃ, ধারা-৩০২/২০১/৩৪ দঃ বিঃ রুজু হয়। থানা পুলিশ মামলাটি তদন্তকালে পিবিআই, ময়মনসিংহ জেলা গত ১৫/১১/২০২০ খ্রিঃ স্বউদ্যোগে মামলাটি অধিগ্রহণ করে।
কিন্তু কি লাশের পরিচয়? কারা করেছে খুন? চলতে থাকে তদন্ত কার্যক্রম। ভিকটিমকে সনাক্তের জন্য তার ছবি সোশাল মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়ার প্রচার করা হয়। ময়মনসিংহসহ আশপাশের জেলা সমূহে লাশের ছবি দিয়ে পোষ্টারিং করা হয়। এছাড়াও ময়মনসিংহ হতে চলাচলকারী বাসের পিছনে পোষ্টারিং করা হয়। জব্দকৃত আলামত বারবার পরীক্ষা করা হয়। একপর্যায়ে লাগেজে একটি আইডেন্টিটি মার্ক পাওয়া যায়। তারই সূত্র ধরে এগোতে থাকে মামলার তদন্ত কার্যক্রম।
গৌতম কুমার বিশ্বাস, পুলিশ সুপার, পিবিআই, ময়মনসিংহ জেলার তত্ত্বাবধানে ও দিক নির্দেশনায় তদন্তকারী অফিসার পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ) জনাব মোঃ আবুল কাশেম, পিপিএম গত ২৭/০১/২০২১ খ্রিঃ রাত অনুমান ০৮.০০ ঘটিকার সময় মধ্য বারেরা এলাকা হতে আবুল খায়ের মোঃ জাকির হোসেন @ সোহাগ (৪৪), পিতা-আঃ কুদ্দুছ, সাং-গঙ্গাদাস গুহ রোড (তৈমুর টাওয়ার), কোতোয়ালী সদর, ময়মনসিংহ ও তার স্ত্রী রিফাত জেসমিন @ জেসি (৩০) দ্বয়কে গ্রেফতার করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে গৌরীপুরের গঙ্গাশ্রম এলাকার জোড়া ব্রীজের নীচে পাওয়া লাগেজ বন্দি অজ্ঞাত মেয়ের হত্যাকান্ডের রহস্য।
তিন বোনের মধ্যে সবার বড় সাবিনা (২০)। সে লেখাপড়া করেছে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত। তার পিতা সিরাজুল ইসলাম সিরু, সাং-উজান ঘাগরা, থানা-কোতোয়ালী জেলা-ময়মনসিংহ দারিদ্রতার তীব্র কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে বন্ধ করে দেন মেয়ের লেখাপড়া।
সিরাজুল ইসলাম একটু উন্নত জীবনের আশায় তার মেয়ে সাবিনাকে কোতোয়ালী থানাধীন গঙ্গাদাস গুহ রোড এর তৈমুর টাওয়ারে বসবাসরত মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আবুল খায়ের মোঃ জাকির হোসেন @ সোহাগ এর বাসায় রাখেন গৃহকর্মী হিসেবে।
সামান্য ত্রæটি বিচ্যুতিতে নেমে আসত শারীরিক ও মানষিক নির্যাতন। বন্ধ হয়ে যায় বাবা মায়ের সাথে দেখা করার ও কথা বলার সুযোগ। গৃহকত্রীর অমানষিক নির্যাতনে তিলে তিলে শরীর শীর্ণকায় হয়ে যায় সাবিনার। ঘটনার দিন গত ০৮/১১/২০২০ খ্রিঃ গৃহকর্তা জাকির হোসেন ও তার স্ত্রী জেসি’র অমানষিক শারীরিক নির্যাতনে নিভে যায় সাবিনার জীবন প্রদীপ। অতঃপর জাকির হোসেন ও তার স্ত্রী জেসি গৃহকর্মী সাবিনার মৃতদেহ লুকানোর পরিকল্পনা করতে থাকেন। পরিকল্পনা মোতাবেক জাকির হোসেন ঐ দিন সন্ধ্যা অনুমান ০৬.০০ ঘটিকার সময় তার ফ্ল্যাটের স্টোর রুম থেকে চটের বস্তা এবং তার মালিকানাধীন পাশর্^বর্তী নির্মাণাধীন ফ্ল্যাট হতে এমএসবি (গঝই) লেখা সম্বলিত ৫ টি ইট সংগ্রহ করেন। চাইল্ড বেডরুমের বারান্দা হতে তার ব্যবহৃত পুরাতন মেরুন কালারের ১টি বড় লাগেজ বের করেন। প্রথমে বস্তার ভিতরে সাবিনার মৃতদেহ ও ৫ টি ইট ভরে বস্তার মুখ বন্ধ করেন আর লাশ ভর্তি বস্তাটি লাগেজে ঢুকান। জাকির হোসেন ও তার স্ত্রী জেসি দু’জন মিলে সাবিনার মৃতদেহ তাদের গাড়ীর পিছনের ডালাতে ভরে রাত অনুমান ০৯.৪০ ঘটিকার সময় গৌরীপুর থানাধীন গঙ্গাশ্রম এলাকার জোড়া ব্রীজের নীচে পানিতে ফেলে দিয়ে আসেন।
গ্রেফতারকৃত আসামী জাকির হোসেন ও তার স্ত্রী জেসি কে গতকাল ২৮/০১/২০২১ খ্রিঃ বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হলে আসামী জাকির হোসেন স্বেচ্ছায় ফৌঃকাঃবিঃ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। উম্মোচন হয় চাঞ্চল্যকর, ক্লুলেস লাগেজ বন্দি লাশের হত্যা রহস্য।
Leave a Reply