রাজশাহীতে এক মেয়েকে জনসমক্ষে এক দল পুরুষ অপমান করেছে, কারণ মেয়েটি রাস্তায় বসে সিগারেট খাচ্ছিল। সিগারেট খাওয়া বারণ এমন কোনও জায়গায় বসে কিন্তু সে সিগারেট খাচ্ছিল না। মেয়েটির সঙ্গী পুরুষটিও খাচ্ছিল সিগারেট, এতে অবশ্য ওদের কোনও অসুবিধে হয়নি। মেয়েটি খাচ্ছিল বলেই অসুবিধে। কেন? মেয়েটি কি ওদের মা, খালা, বউ, বোন বা কন্যা যে ওরা আপনজনের স্বাস্থ্য নিয়ে উদবিগ্ন?
না মেয়েটি ওদের কোনও আত্মীয় নয় যে ‘বড় যে সিগারেট খাচ্ছো, সিগারেট খেলে যে ফুসফুসে ক্যান্সার হয়, জানো না বুঝি?’ বলবে। মেয়েটিকে ওরা চেনে না। কিন্তু ‘মেয়ে হয়ে পুরুষের মতো সিগারেট খাচ্ছো, কোত্থেকে এত স্পর্ধা পেলে’ মূলত ওদের কথাগুলো এই ছিল। মেয়ে হয়ে কেন পুরুষের মতো হতে চাইছে! আপত্তি এখানেই।
আরও পড়ুন : মেয়েটিকে ধুমপান করতে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল ‘বীর বাঙালি’
আমি যখন ভিডিওটি দেখছিলাম আমার মনে হচ্ছিল এই বুঝি পুরুষগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে মেয়েটির ওপর, মেয়েটির শাড়ি খুলে নেবে, ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলবে, উলঙ্গ করে ছেড়ে দেবে। ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো বলবে, চল একে রেপ করি। গণধর্ষণ তো এভাবেই ঘটে। টেনে নিয়ে যায় কোনও ঝোপ ঝাড়ে বা লেকের পাড়ে, বা নদীর ধারে, বা কারো গাড়িতে, বা কারো বাড়িতে। একজনের পর আরেকজন, আরেকজনের পর আরেকজন, আরেকজনের পর আরেকজন। ওরাও তো ওভাবেই ঘৃণা ছুঁড়ছিল মেয়েটির দিকে, মেয়েটিকে গালি দিচ্ছিল। একজনের পর আরেকজন, আরেকজনের পর আরেকজন, আরেকজনের পর আরেকজন।
মেয়েটির সঙ্গে যদি পুরুষ-বন্ধুটি বা আত্মীয়টি না থাকতো, তাহলে আরও বিচ্ছিরি কিছু ঘটতে পারতো। ভিড়ের লোকগুলো নারীবিদ্বেষী ধর্ম-পুলিশদের মতো। কিছু অশিক্ষিত এবং অসভ্য আরব দেশে এরকম লোক সরকার থেকেই মোতায়েন করা হয়। বোরখার বাইরে কোনও মেয়ের চুল দেখা গেলে বা মুখ দেখা গেলে, বা কোনও মেয়ে জিন্স পরলে এভাবেই ছুটে আসে ধর্ম-পুলিশেরা। কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারে, কোরানে তো মেয়েদের সিগারেট না খাওয়ার কথা কিছু লেখা নেই, তাহলে কেন এত লম্ফঝম্ফ।
১৪০০ বছর আগে সিগারেট বলে কিছু ছিল না, পরে যে সিগারেট বলে কিছু একটা আসবে, সেটা তখন নবীজির ধারণা ছিল না , তাই কোরানে এর উল্লেখ নেই। তা না থাকুক, মেয়েরা ঘর থেকে বেরোবে না, বেরোলে পর্দা করতে হবে, পরপুরুষের সামনে নিজের চেহারা দেখাবে না, এসব তো আছে। পুরুষের জন্য যা যা জায়েজ , তা তো মেয়েদের জন্য জায়েজ নয়। নেতৃত্ব, আধিপত্য, একই সঙ্গে একাধিক দাম্পত্য সঙ্গী, দাম্পত্য সঙ্গীকে প্রহার, সম্পত্তির উত্তরাধিকার। ধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী যুক্ত পুরুষতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র যে স্বাধীনতা পুরুষকে দেয়, সেই স্বাধীনতা নারীর কাছ থেকে কেড়ে নেয়। এ কারণেই এই তন্ত্রের নাম পুরুষতন্ত্র, যদি নারী সমান অধিকার পেতো, তাহলে তো সমাজ নিয়ন্ত্রণের এই তন্ত্রটির নাম হতো মানবতন্ত্র।
আরও পড়ুন : তরুণীকে ধূমপান করতে দেখে চড়াও হওয়া সেই ব্যক্তি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা
মেয়েটি সিগারেট পান করেছে, ক্ষতি হলে মেয়েটির হয়েছে। ভিড়ের ওই লিঙ্গপালগুলোর কী ক্ষতি হয়েছে? ওরা নিশ্চয়ই মনে করে মেয়েরা, যে কোনও মেয়েই, তাদের অর্থাৎ সমাজের সম্পত্তি। তারা মনে করে মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার তাদের, যে কোনও পুরুষেরই আছে। তাই তাদের অশিক্ষা কুশিক্ষা নারীবিদ্বেষ এবং মূর্খতা দিয়ে তারা নারীকে নিয়ন্ত্রণ করে। সে কারণেই আজ অধিকাংশ মেয়ের গায়ে চড়েছে বোরখা, নয়, হিজাব । সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের দাবি অনুযায়ী মেয়েরা জীবন যাপন করছে । এই অশিক্ষিত, অসভ্য, ধর্মান্ধ, মূর্খ লোকেরা যেন তুষ্ট থাকে, খুশি থাকে, সেভাবেই চলাফেরা করতে হয় প্রতিটি মেয়েকে।
পরকালের যে নরক, সেটিও সম্ভবত এর চেয়ে ভালো। পরকালের নরক রূপকথার নরক। আর যে নরকে একটি মেয়ের নিজের পছন্দ মতো জীবন যাপনের কোনও স্বাধীনতা থাকে না, সেই নরক বাস্তব। এই নরক বাস ভয়াবহ।
Leave a Reply