কারাগারে চলছে হরিলুট। বন্দিরা কে কত টাকা দিতে পারছেন, তার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় তিনি কতটা সুযোগ-সুবিধা পাবেন। বেআইনি সেসব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কারাগারের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কারারক্ষী ও প্রভাবশালী বন্দি। টেলিফোন, ক্যান্টিন, কোয়ারেন্টিন, চিকিৎসা—এসব নিয়েও চলছে ব্যাপক বাণিজ্য। কারাগারের বিভিন্ন সেল, রুম থেকে আদায় করা হচ্ছে উচ্চ হারে ভাড়া। টাকা দিলে সেখানে সব মেলে। প্রভাবশালী বিত্তবান বন্দিদের জন্য সেখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা উন্মুক্ত।
এ কথাগুলো বলেছেন সম্প্রতি কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়া এক ব্যক্তি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠ’র কাছে কারাগারের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন তিনি।
ওই ভুক্তভোগী বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দুর্নীতির মূল কেন্দ্র হচ্ছে সূর্যমুখী সেল। এই সেলকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন দুর্নীতিবাজ কারা কর্মকর্তাদের সাত লাখ থেকে ৯ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। সেলটিতে অবস্থান করেন বিত্তবান বন্দিরা। প্রধানমন্ত্রীর নামে চেক জালিয়াতি, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজ, মাদক কারবারি—এসব বন্দির স্থান ওই সেলে।
বিত্তবান এবং বিশেষ সুপারিশের বন্দি ছাড়া ওই সেলে অবস্থানের সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, কোন কোন বন্দি সূর্যমুখী সেলে থাকবে তা কারাগারে প্রবেশের পর আমদানি সেল থেকে নির্ধারণ করা হয়। আমদানি সেলেই ভালো থাকা, ভালো পরা ও ভালো খাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় বন্দিদের। এই ভালো থাকা, খাওয়া ও পরার কয়েকটি শ্রেণি রয়েছে। সপ্তাহ হিসেবে নগদ টাকা নেওয়া হয়। সূর্যমুখী ও মধুমতিতে থাকতে হলে ১০ হাজার টাকা লাগে। লেনদেন নগদে। ধারে কোনো কারবার নেই। বিকাশের মাধ্যমেও চাহিদা পূরণ করা যায়। বাড়তি আরো কিছু সুবিধা পেতে ভিআইপি বন্দিদের সপ্তাহে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। এসব ভিআইপি বন্দি সহজেই কারা কর্মকর্তাদের কক্ষে প্রবেশের অনুমতি পান। সেখানে তাঁরা কী সুবিধা লাভ করেন, তা নিয়ে অনেক গুঞ্জন আছে।
ওই ভুক্তভোগী জানান, আমদানি সেল আর কেস টেবিলে কোন বন্দি কত টাকা দিতে পারবে, তাদের সম্পদের পরিমাণ কেমন সে তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। বড় ধরনের অপরাধে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জেল গেট দিয়ে ঢুকলে তল্লাশির সময় বন্দির কাছে যা কিছু থাকে সব হাতিয়ে নেওয়া হয়। নগদ টাকা নিয়ে না ঢুকলে পরিবারের লোকজনের কাছে ফোন করিয়ে টাকা আনার ব্যবস্থা করা হয়।
ওই ভুক্তভোগী বলেন, করোনা মহামারিও এখন কারা কর্মকর্তাদের নতুন আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করছে। বন্দিদের কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য কত টাকায় কী ধরনের সুযোগ দেওয়া হবে, তা-ও নির্ধারণ করা হয় আমদানি সেলে। কোয়ারেন্টিনে টাকার বিনিময়ে পছন্দের বন্দি নিয়ে মাত্র কয়েক দিন থাকারও ব্যবস্থা করা হয়। চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। কারাগারের অন্য সেলগুলো থেকেও বন্দিদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে ভাড়া আদায় করা হয়ে থাকে।
তিনি জানান, টেলিফোন দুর্নীতিও এই কারাগারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কারারক্ষী এবং প্রভাবশালী কিছু বন্দির লুটপাটের অন্যতম উৎস। টেলিফোন থেকে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। সিমভিত্তিক ৪০টার মতো ল্যান্ডফোন চালু রয়েছে এ কারাগারে। এই ফোন কে কতক্ষণ ব্যবহার করবে তাও টাকার বিনিময়ে নির্ধারণ হয়ে থাকে। বেশি টাকায় ফোন ব্যবহারের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ মুক্ত থাকারও সুযোগ মেলে।
কারাগারের ক্যান্টিনও অবৈধ আয়ের আরেকটি উৎস। টাকা ছড়ালে এ ক্যান্টিনে সব কিছুই পাওয়া যায়। তবে বাইরের চেয়ে ১০ গুণ বেশি দামে তা কিনতে হবে। ক্যান্টিনে গরুর মাংসের কেজি এক হাজার ৮০০ টাকা। বন্দিদের জন্য সরকারের বরাদ্দ খাবার নিয়ে হরিলুট বহাল। এ খাবার পশুখাদ্যেরও অযোগ্য।
ওই ভুক্তভোগী জানান, এই কারাগারে আরেক ভীতির নাম চিফ রাইটার। চিফ রাইটারদের মাধ্যমেই লুটপাট ও লুটপাটের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে থাকে। যে কেউ এই চিফ রাইটার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। বড় ধরনের অপরাধী হওয়াও চিফ রাইটারদের অন্যতম যোগ্যতা। চিফ রাইটারদের তিন নম্বর ফ্লোর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। এই ফ্লোরে কারা আইন অচল। জসীম, মিন্টু লাল হওয়ার যোগ্যতা সবার হয় না। এদের সহযোগিতা করেন সুবেদাররা।
ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তি আরো বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা তাঁদের অবৈধ কারবার অব্যাহত রাখতে এই কারাগারে কোনো সাংবাদিক বন্দি রাখতে চান না। ডিজিটাল আইনে আটক এক সাংবাদিক সেখানে বন্দি ছিলেন। তাঁকে নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন ওই কারা কর্মকর্তারা। তাঁরা ওই সাংবাদিককে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
Leave a Reply