মুক্তিযুদ্ধ- প্রতিটি স্বাধীনচেতা মানুষের কাছে একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়। বহুদেশ তাদের বীরত্বের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আমরাও দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ পেয়েছি। তবে এ বিজয় ৩০ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। যাদের অবদানে আজ আমরা বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি, তাদের অন্যতম একজন আনোয়ার উল আলম শহীদ, যিনি দেশমাতৃকার দুঃখমোচনে নানা সংগ্রাম আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রামকে আজীবন অনুধ্যানের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কর্মজীবনে তিনি জাতীয় রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক, কর্নেল, সচিব ও রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তবে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও মননশীল লেখক পরিচয়ে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আনোয়ার উল আলমের মেধা, সংযত আচরণ, সাহস, সততা এবং জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ তার স্বাধীনতাযুদ্ধের আন্দোলনকে আরও গতিময়তা দিয়েছে। ফলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আপন নেতৃত্বগুণে অধিকার করে নেন বিশেষ স্থান। টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছোট ছোট দলগুলোকে পুনর্গঠিত করেন, পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের গঠনমূলক কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে মুক্তাঞ্চলে ‘টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী’ নামে সুদৃঢ় প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীকালে ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ নামে অধিক পরিচিতি লাভ করে। আনোয়ার উল আলম শহীদ শুরু থেকে এ বাহিনীর বেসামরিক প্রধান এবং মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত দুই মাস সর্বাধিনায়কের গুরুদায়িত্বও পালন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সফল সংগঠক হিসেবে যেমন মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে বহুমাত্রিক কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। এ কারণে টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা অপরিসীম।
আনোয়ার উল আলম শহীদ কিশোরকালেই নানা সাহিত্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬১ সালে ‘জাগরি কচি-কাঁচার মেলা’ গঠন, ১৯৬৩ সালে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাস ‘বিষাদসিন্ধু’খ্যাত মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক ‘হিতকরি’র ‘কিশোর প্রাঙ্গণে’র পরিচালক এবং ১৯৬৪ সালে ‘জাগরি কচি-কাঁচার মেলা’র আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এছাড়া ‘জাগরি’, ‘সূর্যের গান’, ‘আয়না’ ইত্যাদি ম্যাগাজিন সম্পাদনাসহ ১৯৭১ সালে ‘রণদূত’ ছদ্মনামে সাপ্তাহিক ‘রণাঙ্গন’ সম্পাদনা করেন। এতসব কিশোর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে ৭৩ বছর বয়সেও তার মনটা রয়ে গিয়েছিল তরুণ ও সতেজ। শিশু-কিশোরদের সঙ্গে সময় কাটাতে তিনি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আড্ডায় কেউ না এলে ক্ষুদেবার্তা পাঠাতেন। ২০১৯-এর কোনো একদিন আমাকেও একটি বার্তা লেখেন- ‘আমি এখন টাঙ্গাইলে, চলে আসো। জরুরি কথা আছে।’ আমি চলে এলে তিনি বললেন, ‘আমাদের বিবাহোত্তর জীবনটা চার দশক পেরিয়ে গেছে, অথচ তোমার ভাবিকে (ডা. সাঈদা খানকে) তেমন কিছুই দিতে পারিনি। ‘ডা. সাঈদা খান : একজন সফল মানুষের কথা’ শিরোনামে তুমি একটি জীবনীগ্রন্থ লিখবে। তার জীবনের অনেক সফলতার গল্প আছে। যিনি দেশের বাইরে থেকেও স্বদেশিদের জন্য নানা কার্যক্রমে সদা ব্যস্ত থাকতেন। তথ্য সব আমি দেব। ২০২০-এ তার জন্মদিনে তাকে বইটি উপহার দেব। তবে কথাটি গোপন রাখবে। তোমার ভাবিকেও (ডা. সাঈদা খানকে) জানাবে না।’ আমি কথামতো তথ্য নিয়ে কাজ শুরু করলাম। লেখাও প্রায় শেষ। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে তা আর প্রকাশ করা সম্ভব হল না। জন্মদিনের অনুষ্ঠানও হল না। গত ১০ ডিসেম্বর আনোয়ার উল আলম শহীদও তার স্বপ্নটিকে বাস্তবায়ন না করেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আর কোনোদিন তিনি কোনো কাজে আমাকে ডাকবেন না। হয়তো বইটি প্রকাশ হবে, বছর ঘুরে ভাবির জন্মদিনও আসবে। কিন্তু এতসব কিছুর আয়োজককে আর পাব না। তার এই অপূর্ব ভালোবাসার নিদর্শন ডা. সাঈদা ভাবিকে আরও অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখবে, আশা করি।
সবুজ মাহমুদ : সম্পাদক, চতুর্মাসিক যমুনা
Leave a Reply