হরেক রকমের শাক-সবজি বাজারে আসতে শুরু করেছে। এ সময় বাজারে প্রচুর সবজি আসায় বছরের অন্য সময়ের চেয়ে সস্তা থাকে। ফলে সবজির ন্যায্য মূল্যটাও পান না কৃষক। এর কারণ বাজারে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া ও আড়তদারের যন্ত্রণা। সরবরাহের দোহাই দেখিয়ে এসব ফড়িয়া ফায়দা লুটে নিচ্ছে বলে অভিযোগ কৃষকের। নীলফামারী থেকে কাওরান বাজারে আসা কৃষক মাসুদ মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীরা আমাদের কাছ থেকে ১০ টাকার সবজি কিনে আড়তদারের কাছে বিক্রি করছেন ২০-২৫ টাকা। আড়তদার সেই সবজি বিক্রি করছেন ৩০ থেকে ৩৫ টাকা । আর খুচরা বাজারে সেই একই সবজি বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা।ফলে সবজির দাম খুচরা বাজারে থাকে আকাশছোঁয়া। এ ব্যাপারে কথা হয় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, অন্য মৌসুমের চাইতে শীতকালে সব ধরনের সবজির ফলনই ভালো হয়। যে কারণে এই সময় বাজারে সবজির সরবরাহ বেশি থাকায় দাম কমে যায়। বিপদে পড়ে কৃষক। শীতকালীন এসব সবজি প্যাকেজিং করে সংরক্ষণ করা গেলে ক্রেতা ও কৃষক উভয়ই উপকৃত হতেন। কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ বিদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সবজি রপ্তানি করতে পারছে না। বিদেশি বাজারে বাংলাদেশি সবজি রপ্তানি সমপ্রসারণ বাড়াতে হবে। তবে এজন্য বিদেশি বাজার চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মানসম্মত সবজির নিরন্তর সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। সে লক্ষ্যে দরকার চুক্তিভিত্তিক ভালো মানের সবজি উৎপাদন। প্রয়োজন সংগ্রহোত্তর যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ। আরো প্রয়োজন উন্নততর গ্রেডিং, প্যাকেটজাতকরণ ও পরিবহন। এ ছাড়া বিদেশে সবজি পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত বিমান স্পেস নিশ্চিতকরণের সঙ্গে এর ভাড়া হ্রাস করাও সবজি রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। সর্বোপরি যেটি প্রয়োজন, সেটি হলো বিদেশে বাংলাদেশি সবজির বাজার সমপ্রসারণের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো। বিদেশে অর্গানিক সবজির বেশ কদর। দেশের অভ্যন্তরেও এদের চাহিদা আছে বেশ। অতি সমপ্রতি দেশের কোথাও কোথাও নিরাপদ সবজি বাজারজাতকরণের জন্য ফারমার্স মার্কেট চালু করা হয়েছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। বাড়াতে হবে এসব মার্কেট। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি মিশনগুলো এর বাজারজাতকরণে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। এ লক্ষ্যে বিদেশি বাজার ও পণ্যমূল্য সম্পর্কে আমাদের রপ্তানিকারকদের নিয়মিত অবহিত রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।
খুচরা বাজারে বাঁধাকপি বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস ১০ থেকে ২০ টাকা, বড় সাইজের ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা। অথচ কাওরান বাজারে কপি নিয়ে আসা কৃষক ইকবাল হাসান জানান, প্রতি পিস কপি আনতে তাদেরকে ৪ টাকা গাড়ি ভাড়া দিতে হয়েছে।
অথচ কপি বিক্রি করলাম ৫ টাকা করে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা বাঁচবো কীভাবে? বেগুন পাইকারি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭ টাকা। খুচরা বাজারে সেটা বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা করে। শিম পাইকারি প্রতি কেজি ১০ টাকা, খুচরা বাজারে ২০ টাকা। ধনে পাতা পাইকারি প্রতি কেজি ১০টাকা, খুচরা বাজারে ৩০-৪০ টাকা। এতে কৃষক অর্ধেক দামও পাচ্ছে না বলে জানান পাবনার কৃষক শরিফুল। তিনি বলেন, আমাদের উৎপাদিত সবজির সুবিধা যাচ্ছে ফড়িয়া আর আড়তদারদের পকেটে। ভুক্তভোগী কৃষকের দাবি, সরকার যেন দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।
করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলাতে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষক এবার চেষ্টা করেছেন তাদের জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের। কিন্তু তার আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন না। ডুমুরিয়ায় শীতের সবজি এখন বিক্রি হচ্ছে প্রায় পানির দরে। এতে হতাশ কৃষক। ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে তাদের। আড়তে এসে হতাশা প্রকাশ করা ছাড়া যেন আর কিছুই করার ছিল না ডুমুরিয়ার মালতিয়া গ্রামের চাষি আব্দুল মজিদের। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন একই উপজেলার আরশনগর গ্রামের সঞ্জয় দেবনাথ। তারা উভয়ই ফুলকপি চাষি। গত ৯ই ডিসেম্বর মালতিয়া আড়তে তারা প্রতিকেজি ফুলকপি বিক্রি করেছেন চার টাকা কেজি দরে। মার্চে করোনা মহামারি শুরুর পর মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়শ, পেঁপে, লাউ, পুঁইশাকসহ বিভিন্ন ফসলে বড় ধরনের লোকসানের সম্মুখিন হন চাষিরা। শষা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩-৪ টাকা। কাঁচামরিচ ও করল্লা পানির দামে বিক্রি হয়। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন কৃষকরা। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রধানমন্ত্রী এক ইঞ্চিও জমি খালি না রাখতে নির্দেশনা দেন। চাষে উৎসাহিত হতে খুলনার এক হাজার তিনশ’ কৃষক প্রণোদনাও পান। কিন্তু তারপরও খুলনা জেলার ৮০ হাজার কৃষক গ্রীষ্ম মৌসুমে সবজি বিক্রি করতে না পেরে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আশা ও গ্রামীণ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সমিতিতে সুদ ও ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে তাদের।
ডুমুরিয়ার বরাতিয়া, গোবিন্দকাটি, ঠাকুন্দিয়া, খর্নিয়া, আরশনগরে শত-শত বিঘা জমিতে ফুলকপির আবাদ হয়েছে। নভেম্বরের প্রথমদিকে চাষিরা প্রতি কেজি ফুলকপি ৮০ টাকা দরে বিক্রি করেন। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রতি কেজি’র পাইকারি মূল্য ছিল ৪০ টাকা। কিন্তু ৯ই ডিসেম্বর কৈয়াবাজার, খর্নিয়া ও মালতিয়া আড়তে প্রতি কেজি’র মূল্য ছিল চার টাকা। বরাতিয়া গ্রামের ললিত দাস জানান, এক বিঘা জমিতে ছয় হাজার আর দশ কাঠা জমিতে তিন হাজার ফুলকপির আবাদ করেছেন। বীজ, সার, কীটনাশক ও দৈনিক শ্রমিকের ব্যয়সহ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। অক্টোবরের প্রথমদিকে ফুলকপির চারার গোড়ায় পচন ধরে। আবাদ রক্ষা করতে নানা উপকরণ ব্যবহার করতে হয়। সবজির আবাদ করতে মহাজনদের কাছ থেকে তিনি পাঁচ টাকা সুদে ঋণ নিয়েছেন। তার জমিতে ফুলকপির বাম্পার ফলনও হয়েছে। আশা ছিল করোনার ধাক্কার লোকসান সামলে নিতে পারবেন। কিন্তু ফল হলো উল্টো। গত বুধবার সাড়ে চার মণ ফুলকপি বিক্রি করেছেন। কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি। আরশনগর গ্রামের সঞ্জয় দেবনাথ আশা ও গ্রামীণ সমিতি থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। বুধবার তিনি মালতিয়া বাজারে ১০ মণ ফুলকপি বিক্রি করতে আসেন। প্রতি কেজির মূল্য চার টাকা দেখে হতাশ হন।
আড়তদাররা জানান, এখন সবজির ভরা মৌসুম। একসাথে সব ধরনের সবজি বাজারে আসায় কপিসহ সকল সবজির দাম কমে গেছে। বন্যায় বিভিন্ন ধরনের আগাম সবজি নষ্ট হওয়ায় এবার ফুলকপি আবাদ হয়েছে বেশি। এ কারণে কপির ভালো ফলন হলেও ক্ষতির মুখে রয়েছে কৃষক।
মানিকগঞ্জ কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সাহজাহান আলী বিশ্বাস মানবজমিনকে বলেন, জেলায় এবার গত বছরের তুলনায় অধিক সবজির চাষ হয়েছে। অন্য বছরের তুলনায় এবার ফলনও ভাল হয়েছে। প্রথমদিকে যেসব কৃষক ফুলকপির চাষ করেছে এবং বাজারে আনতে পেরেছে, তারা দাম ভালোই পেয়েছে। পরে যারা চাষ করেছে, তারা প্রত্যাশিত মূল্য পাচ্ছে না। সব ধরনের সবজি একসাথে বাজারে আসায় বর্তমানে ফুলকপির দাম কমেছে। এতে করে কিছু কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে। মানিকগঞ্জে তিন চারটা হিমাগার আছে। তবে সেগুলো ফুলকপি, বাধাকপি, ধনে পাতার জন্য নয়। এসব সবজির জন্য হিমাগার করা গেলে কৃষক কিছুটা হলেও উপকৃত হতেন। সেটা করা যায় কিনা, ঊর্ধ্বতন মহলকে জানাবো।
Leave a Reply