করোনাভাইরাস, বৈরী আবহাওয়া আর অবরোধের মধ্যদিয়ে প্রায় শেষের পথে এবারের ইলিশ মৌসুম। এই তিন সংকটের কারণে কোটি কোটি টাকা লোকসানে পড়েছে উপকূলীয় বাগেরহাটের শরণখোলার পাঁচ সহস্রাধিক জেলে-মহাজন। ভরা মৌসুমে জেলের জালে তেমন একটা ইলিশ আটকা পড়েনি। কিন্তু ঋণ-সুদ-দাদনের জালে ঠিকই আটকা পড়েছে জেলে-মহাজন উভয়ই। এসব সমস্যা-সংকটের মধ্যেও নতুন স্বপ্নের জালবুনে আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তারা।
২২ দিনের ইলিশ অবরোধ শেষে হবে ৪ নভেম্বর। ওইদিন গভীর রাত থেকে আবারো দেশের সকল নদ-নদীতে স্বাভাবিক নিয়মে শুরু হবে ইলিশসহ সবধরণের মৎস্য আহরণ। সেই আশায় অন্যান্য এলাকার মতো শরণখোলার জেলে-মহাজনরাও অবরোধের অবসর সময়ে জাল-ট্রলার মেরামত করে অপেক্ষায় রয়েছেন সাগরে যাওয়ার।
এদিকে, অবরোধে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা মৎস্য আড়তে একে একে আসতে শুরু করেছে জেলেরা। মৎস্যপল্লীগুলো জেলেদের আগমনে আবার সরব হয়ে উঠলেও হাসি নেই কারো মুখে। মহাজনরা কোটি কোটি টাকা দাদন দিয়ে কাঙ্খিত ইলিশ না পাওয়ায় হতাশ। জেলে শ্রমিকরা হাজার হাজার টাকা সমিতির ঋণ এবং সুদের জালে জড়িয়ে পড়েছে। অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পালিয়ে গেছে। উপজেলার বিভিন্ন মৎস্য আড়ত ও জেলেপল্লী ঘুরে এমন দুর্দশার তথ্য পাওয়া গেছে।
এফবি উর্মি ফিশিং ট্রলারে জেলে কলিম হাওলাদার জানান, এ বছর সাগরে তেমন ইলিশ ধরা পড়েনি। তাছাড়া মৌসুমের তিন মাস চলে গেছে অবরোধে। কয়েক দফা দুর্যোগে সাগরে এক মাসের বেশি জাল ফেলা যায়নি। এই সময়ে কাজ না থাকায় সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয়। একারণে ব্র্যাক থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ এবং মহাজনের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে সংসারে খরচ করে এখন দেনায় ডুবুডুবু।
জেলে বাচ্চু ফকির গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৩০ হাজার এবং গ্রাম থেকে সুদে ১০ হাজার, কালাম খান সুদে ১০ হাজার, হেলাল খান বউয়ের স্বর্ণালঙ্কার বন্দক রেখে ৩৫ হাজার এবং মহাজনের কাছ থেকে ৩০ হাজার, জাহিদুল তালুকদার মহাজনের কাছ থেকে নিয়েছেন ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন। এভাবে শরণখোলার প্রত্যেক ফিশিং ট্রলারের জেলেরা ত্রিমুখী সংকটে পড়ে সুদ, ঋণ এবং দাদনের জালে আটকা পড়েছে।
উর্মি ট্রলারের মালিক শহিদুল ইসলাম খান জানান, চলতি ইলিশ মৌসুমে ১৭ লাখ টাকা পুঁজি খাটিয়েছেন। কিন্তু লাভের মুখ দেখেননি। এবার তার লোকসান হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। তাছাড়া ট্রলারের ১৮জন জেলেকে ধার দিয়েছেন পাঁচ লাখ টাকা।
শরণখোলা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আড়তদার মেসার্স তালুকদার এন্টারপ্রাইজের মালিক মজিবর তালুকদার জানান, তিনি ২৫টি ট্রলারের একেকটিতে ৭-৮ লাখ টাকা করে দুই কোটি টাকার বেশি দাদন দিয়েছেন।
বাগেরহাট জেলা ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মো. আবুল হোসেন বলেন, শরণখোলায় ৪ হাজার ৮২০ জন কার্ডধারী জেলে, ছয় শতাধিক ট্রলার মালিক ও আড়তদার সবাই ঋণগ্রস্ত। বেশ কয়েকটি ট্রলারের জেলে দেনা শোধ করতে না পেরে পালিয়ে গেছে। ভরা মৌসুমে ৬৫ দিনের অবরোধই আমাদের মূল ক্ষতির কারণ। ২২ দিনের অবরোধ আমরা সবাই যথাযথভাবে পালন করেছি। এটা আমরা মেনেও নিয়েছি। কিন্তু ৬৫ দিনের অবরোধটা না দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।
শরণখোলা উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা বিনয় কুমার রায় বলেন, এ বছর করোনাসহ বিভিন্ন কারণে শরণখোলার জেলে-মহাজনরা লোকসানে আছেন। তারপরও এখানকার মৎস্য সংশ্লিষ্টরা সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সবগুলো অবরোধ সফলভাবে পালন করেছে। এজন্য মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। জেলে-মহাজনদের ৬৫ দিনের অবরোধ তুলে নেওয়ার দাবি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।
Leave a Reply