মৃত্যুর খুব বেশি আগে নয়, সোভিয়েত লৌহমানব স্ট্যালিন একদিন হঠাৎ করেই উধাও করে দেন তার প্রাইভেট সেক্রেটারিকে। দশকের পর দশক ধরে তার এই ‘অল্টার ইগো’ কম-বেশি কাজ করেছে সবখানে। ১৯৫৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তার প্রধান দেহরক্ষীর ‘প্রিম্যাচিউর ডেথ’ ঘোষিত হলো সরকারিভাবে। সন্দেহ নেই তিনি ইউফেরিজম ফর এক্সিকিউশনের শিকার। স্ট্যালিনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক তখনো বন্দিশালায় আটক। চার দিকে গুজব এই গ্রেটম্যান অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ডিসেম্বর থেকেই অভিজাত মহলে এ গুজব ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তার কন্যা এস্ভেটলানা (ঝাবঃষধহধ) তার কাছে যেতে পারছিলেন না, যদিও তিনি বারবার প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তার বাবার কাছে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কয়েক মাস আগে তিনি দেখেছিলেন বাবা স্ট্যালিন ক্রমেই অপচিত হয়ে পড়ছিলেন আর্টেরিওসক্লেরোসিস অর্থাৎ এক ধরনের ধমনীর প্রদাহের কারণে।
২ মার্চে স্ট্যালিন সেরিব্রাল হেমারেজের শিকার হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু স্ট্যালিনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আতঙ্কিত মহলটি এই খবর গোপন রাখে। ক্রুশ্চেভের মতে, এর আগের দিন স্ট্যালিন চার ঘনিষ্ঠকে তার কুনজেভোর গ্রীষ্মকালীন বাড়িতে দাওয়াত করে আনেন রাতের পানের ও রগড় গালগল্পের আয়োজনে। কিন্তু পার্টি ভেঙে যাওয়ায় অল্পক্ষণের মধ্যেই স্ট্যালিন একা শুতে চলে যান। মার্চের ৩ তারিখে রাত ৩টার পর ভীতসন্ত্রস্ত দেহরক্ষীরা জানায়, ২৪ ঘণ্টা ধরে সোভিয়েত চিপটেনকে দেখা যায়নি। যখন এরা সাহস করে তার প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত ইনার স্যাঙ্কটাম বা অন্তর্দেশে প্রবেশ করে, তখন দেখেতে পেল পুরোপুরি পোশাকপরা অবস্থায় একটি কম্বলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন স্ট্যালিন।
দৃশ্যত বিস্মিত ও আশঙ্কিত ম্যালেনকভ ক্রুশ্চেভ, বুলগেনিন ও বেরিয়া দ্রুত আসেন তাদের আলাদা আলাদা বাড়ি থেকে। এসে দেখেন স্ট্যালিনকে তখনো একটি সাধারণ কোচে অস্বাভাবিকভাবে রাখা হয়েছে। এক সময় ডাক্তার ডেকে আনা হলো। চার সহকর্মী ও সরকারি দলের অন্য প্রেসিডিয়াম সদস্যরা দু’জন দু’জন করে পালা করে তার চিকিৎসা তদারকি করেন। একই সময়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও প্রণয়ন করেন।
পরবর্তী দিনগুলোয় ক্রুশ্চেভ ও অন্যদের চোখ লাল করে কাঁদতে দেখা গেছে। কিন্তু বেরিয়ার আচরণ ছিল অনেকটা বিস্ময়কর। মাঝে মধ্যে স্ট্যালিনের চোখের পাতা যখন নড়ে উঠত, তখন আতঙ্কে বিস্ময়ীভূত নিরাপত্তা প্রধান ল্যাভরেন্টি বেরিয়া প্রকাশ করতেন তার উদ্বেগ ও সহানুভূতির কথা। কিন্তু যখন মনে হলো স্ট্যালিন আবার কোমায় চলে গেছেন, বেরিয়া অন্যদের কাছে তার পুরনো মেন্টর স্ট্যালিন সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে সবার মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করতেন। তার এই আচরণের মধ্য দিয়ে তিনি অন্যদের কাছে কী আভাস-ইঙ্গিত পৌঁছাতে চেয়েছিলেন সেদিন? ১৯৩৮ সাল থেকে বেরিয়া ছিলেন সিক্রেট পুলিশ বাহিনীর প্রধান। তিনি ছিলেন স্ট্যালিনের অমনিপটেন্সের সত্যিকারের উৎস।
৪ মার্চ স্ট্যালিন হঠাৎ জেগে ওঠেন। তখন নার্স একটি চামচ দিয়ে তাকে খাওয়াচ্ছিলেন। তখন তিনি দেয়ালে টাঙানো একটি ছবির দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। ছবিতে এক মহিলা ঠিক তার মতো একটি মেষশাবককে চামচ দিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে। এর কতক্ষণ পরই তিনি তার অনুসারীদের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে তীব্র আক্ষেপ নিয়ে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়েন। এর পর বেরিয়া হয়ে ওঠেন মস্কোর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু।
এই দিনটিতেই তার মৃত্যুর আগে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের ৮০ কোটি মানুষ এবং সেই সাথে বাকি দুনিয়ার মানুষ জানতে পারে স্ট্যালিন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চিকিৎসক তার রোগ সম্পর্কে যে অস্বাভাবিক ব্যাখ্যা দিলেন, তাতেও ছিল জটিলতা। শেষ পর্যন্ত ৬ মার্চ সরকারি রেডিওতে ঘোষণা দেয়া হয়, স্ট্যালিনের হৃদস্পন্দন আগের রাত ১০টা ১০ মিনিটের সময় থেমে গেছে। একটি পূর্ণ অটপ্সি রিপোর্টে বলা হয়, আরোগ্যের অনুপযোগী এ রোগের মোকাবেলায় সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি চেষ্টা চালানো হয়েছে।
বিকেল ৪টার দিকে হাউজ অব দ্য ট্রেড ইউনিয়নের হল অব কলামসে প্রচুর তাজা ফুলে ঢাকা অবস্থায় তার লাশ রাখা হয়। মনে হচ্ছিল মস্কোর সব মানুষ যেন লাইন ধরেছে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। সম্ভবত পরের তিন দিনে ৫০ লাখ মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানান। দুর্ভাগ্য, অনেকেই আহত বা নিহত হয়েছিল যখন বিব্রত জেনারেলেরা জনগণকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন। তারা আদেশ দিলেন, শোকাভিভূত জনতাকে নিচতলায় লোহার জানালার বাইরে আটকে দিতে।
স্ট্যালিন ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৭ বছরের উৎপীড়ক স্বৈরশাসক। মনে করা হয় তিনি দায়ী ছিলেন দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ সোভিয়েতের মৃত্যুর জন্য। তার পরও ৬ মার্চ তার মৃত্যুর খবর ঘোষিত হওয়ার পর লাখ লাখ মানুষকে তার মৃত্যুতে কাঁদতে দেখা গেছে। কারণ, তার নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয় পেয়েছে। তিনি ছিলেন তাদের নেতা, ‘ফাদার অব দ্য পিপল’, সুপ্রিম কমান্ডার, দ্য জেনারেলিসিমো।
স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর তার লাশ ধোয়ার কাজটি করেন একজন নার্স। এরপর তার লাশ একটি সাদা গাড়িতে করে ক্রেমলিন মর্চুয়ারিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর চলে তার লাশের এমব্যামিংয়ের (বসনধষসরহম) অর্থাৎ লাশের ওপর রাসায়নিক প্রলেপ লাগানোর কাজ।
১৯২৪ সালে লেলিন যখন মারা যান, তখন তার লাশের এমব্যামিং করেন প্রফেসর ভরোবিয়েভ। তখন এ কাজটি ছিল বেশ জটিল। একটি ইলেকট্রিক পাম্প লেনিনের শরীরজুড়ে দিতে হয়েছিল লাশকে অব্যাহতভাবে আর্দ্র রাখার জন্য। ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিন যখন মারা যান, এর আগেই গত হয়েছেন প্রফেসর ভরোবিয়েভ। ফলে স্ট্যালিনের লাশের এমব্যামিং করেন প্রফেসর ভরোবিয়েভের সহকারী প্রফেসর জারস্কি। এই এমব্যামিংয়ের কাজ চলে কয়েক মাস ধরে। স্ট্যালিনের মৃত্যুর সাত মাস পর ১৯৫৩ সালের নভেম্বরে এসে তার কবর আবার খোলা হলো। তখন স্ট্যালিনের লাশ কাচের নিচে একটি কফিনে রাখা ছিল।
৯ মার্চ তাকে সমাহিত করা হয়। সেটি ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় মাপের শেষকৃত্য তথা সমাহিত করার আয়োজন। ওই দিন সোভিয়েত ইউনিয়নের সব কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা হয়। শেষকৃত্যে আসা প্রতিনিধিদের দিয়ে ভরে যায় পুরো রেড স্কোয়ার। বহু রাষ্ট্রপ্রধান এতে যোগ দেন। স্ট্যালিনের উত্তরাধিকারীরা বয়ে নিয়ে যান শবযানের আচ্ছাদনবস্ত্র। কমিউনিজমের ‘লিটল ফাদার’ বলে খ্যাত স্ট্যালিনকে সমাহিত করা হলো মস্কোর রেড স্কোয়ারে লেনিন টম্বে সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা লেনিনের কবরের পাশে।
Leave a Reply