1. iamparves@gmail.com : admin :
  2. janathatv19@gmail.com : Shohag Khan : Shohag Khan
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৮:৫৩ পূর্বাহ্ন

একটি কাগজের রঙিন টুপি

ফাস্টবিডিনিউজ ডেক্স
  • প্রকাশের সময় : বুধবার, ২৮ জুন, ২০২৩
সংগৃহীত

আনন্দে ঈদের আগের দিন রাতে ঘুম আসতে চাইত না। কখন সকাল হবে আর ঈদগাহে যাওয়া হবে। মা বলতেন, এখন ঘুমা। সকালে সবার আগে তোকে উঠতে হবে। শেষ রাতে ঘুম ধরলে আর ওঠতে পারতাম না। সবার আগে ঘুম থেকে উঠতেন মা। মায়ের এই অভ্যাসটা শুধু ঈদের দিনের নয়; তিনি অন্য সময়ও সবার আগে ঘুম থেকে উঠতেন। ফজরের নামাজ পড়তেন। তারপর ঘরদোর উঠান আঙিনা ঝাড়ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করতেন। এখনো তিনি তাই-ই করেন। এত বয়স হয়েছে, এখনো আমরা তার আগে বিছানা ছাড়তে পারিনি। মায়েরা কেনজানি এমনই হয়। অন্য দিন বেলা করে ঘুম থেকে উঠলেও সমস্যা নেই। কিন্তু ঈদের দিন সকালে জোর করেই মা আমাদেরকে ওঠাতেন। বলতেন, ‘আজ ঈদের দিন। ওঠ ওঠ! তাড়াতাড়ি গোসল শেষ কর। নতুন জামা পরে ঈদগাহে যেতে হবে। আব্বা ফজরের নামাজ পড়ে এসে রেডি।’ আমি একা একা গোসল শেষ করে বাড়ির বাইরে এসে দেখতাম- পাড়ার ছেলেমেয়েরাও রেডি। এই ফাঁকে মা সেমাই রান্না করে ফেলেছে। সেই সেমাই খেয়ে মিষ্টিমুখ করা। নতুন জামাকাপড় পরা। আতর সুরমা লাগানো। সবই হতো। মা নিজ হাতে সবাইকে চোখে সুরমা পরিয়ে দিতেন; আর বলতেন, সুরমা পরা সুন্নাত। আতর লাগানো সুন্নাত। মা আমাদের তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ বারবার পড়াতেন। বলতেন, এটা পড়া সুন্নাত। এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে গিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা ভালো। এই ছিল ঈদগাহে যাওয়ার জন্য মায়ের দেয়া ট্রেনিং। মা সুরমা পরানো শেষ করলে, বাবার সাথে সাথে ঈদগাহ মাঠে যেতাম। সে এক অন্য রকম ভালো লাগা। ঈদগাহের অদূরে বসত মিষ্টি মিঠাইয়ের দোকান। কিছু দোকান খেলনার। হরেক রকম খেলনা সাজানো থাকত। দোকান বসত মেলার মতো করে। বাবার সাথেই যেতাম। কিন্তু মেলার দিকে বারবার আমার মন টানত। বাবা জোর করে আগে ঈদগাহে নিয়ে যেতেন। নামাজ শেষ করে তারপর মিষ্টিমিঠাই, খেলনা, বেলুন, বাঁশি কিনে বাড়ি ফিরতাম। চিন্তাভাবনাহীন আনন্দের শেষ ছিল না সেসব ঈদে।

শিশু থেকে কিশোর বয়স পর্যন্ত তো শুধু একটা ঈদ আসে না! এক এক করে অনেক ঈদ আসে। ঈদুল আজহা আসে। ঈদুল ফেতর আসে। প্রতি বছরই আসে। ঈদুল ফেতরের স্মৃতিগুলো বেশি বেশি আমার চোখে ভাসে। ঈদুল আজহার স্মৃতিও ভাসে। তবে কম। ঈদুল ফেতরের আগে রোজা, সাহরি, ইফতার, নতুন জামা কেনা, এসব থাকে। সেজন্য এই ঈদে আনন্দও বেশি। ঈদুল আজহাতে এসব হয় না। ঈদুল ফেতর বা রোজার ঈদে চাঁদ দেখার একটা ব্যাপার থাকে। ঈদের আগের দিন নতুন চাঁদ দেখা ছিল আমার কাছে অসম্ভব আনন্দের। এখনো রমজানের এবং ঈদের চাঁদ দেখার জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে হয়ে ওঠি। পরিষ্কার পশ্চিম আকাশে চিকন বাঁকা চাঁদটি যখন বহু চেষ্টা করে চোখে পড়ে, তখন দীর্ঘ সময় নিয়ে সেটা দেখতে থাকি। বিশেষ করে রমজানের চাঁদটি আমাকে আপ্লুত করে। গোধূলি লগ্নে বিশাল আকাশের পশ্চিম প্রান্তে কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ। যেন কি এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্বের ইঙ্গিত দিয়ে যায়। তখন হৃদয়ের গভীর থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে- আসসালামু আলায়কুম ইয়া আল হেলাল। কোনো সময়ে চোখের কোণা বেয়ে দু’ফোঁটা পানিও গড়িয়ে যায়। আচমকা মনে হয়; কে যেন হাতছানি দিয়ে বেহেশতের সৌগাত বিলাতে চায়। তখন রোজা রাখার জন্য মনটা ছটফট করে। অপেক্ষা করতে থাকি, কখন সাহরির ডাক পড়বে! আর আগামীকাল রোজা রাখা হবে।

বিরতিহীন এক মাস রোজা রাখা শেষে যখন ঈদের চাঁদ ওঠে, তখনো চাঁদ দেখার জন্য মনটা আনচান করতে থাকে। ঈদের আগের দিন ইফতারের আগেই একবার চাঁদ দেখার চেষ্টা করতাম। দেখা না গেলে ইফতার, মাগরিবের সালাত শেষ করে চেষ্টা করতাম। দীর্ঘ সময় নিয়ে চাঁদ দেখার চেষ্টা করতাম। আমাদের বাড়ির দক্ষিণে খোলা মাঠ। আবাদি জমি। জমির আলে দাঁড়িয়ে পাড়ার ময়না, বেলি, জুঁই, সাব্বির, ফরিদ, রতন, পলাশ সবাই মিলে চাঁদ দেখার চেষ্টা করতাম। পলাশ চোখে কম দেখত। ও কোনোভাবেই চাঁদ দেখতে পেত না। কিন্তু ও নাচত। যখন চাঁদ দেখা যেত, তখন সবাই হৈ হৈ করে ওঠত আর মনের আনন্দে নাচত। কিন্তু আমি নাচতে পারতাম না। আনন্দঅশ্রুতে আমার বুক ভেসে যেত। মনে মনে চাঁদকে ছালাম জানাতাম। এখনো আমি বাড়ির ছোটদেরকে নিয়ে প্রতিটি ঈদে চাঁদ দেখার চেষ্টা করি।
রোজার ঈদের দিন আমাদের বাড়িতে গরুর গোশত আর চালের আটার রুটির ব্যবস্থা করা হতো। গোশত রুটি বাড়ির সবারই পছন্দের খাবার। ঈদগাহ থেকে ফিরে দেখতাম, তিন রাস্তার মোড়ে গরু জবাই করা হয়েছে। বাবা আমাকে সেখান থেকে গোশত নিয়ে আসার জন্য পাঠাতেন। গোশত নিয়ে এসে দেখি, মা রুটি তৈরি করছে। মায়ের কাছে গোশত রেখে দৌড় দিতাম উঠানে। ছেলেমেয়েদের সাথে খেলতে। দিনভর খেলা আর খেলা। রান্না শেষ করে মা আমাদের খেতে ডাকতেন। মাদুর পেতে সবাই মিলে একসাথে গোশত রুটি খেতাম। কোনো আত্মীয় কোন কোন দিন দাওয়াত খেতে আসবে; খেতে খেতে মা’র উদ্দেশ্যে বাবা তা বলতেন; মা যেন তার প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। খাওয়া শেষে বাবা যেতেন তার বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করতে। আর আমি যেতাম গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, কানামাছি খেলতে।

এ বয়সে এসে এত দিনেও আমি যেটা পারিনি আমার আব্বা সেটা পারতেন। প্রতিটি ঈদেই আব্বা একটা করে ভিন্ন ব্র্যান্ডের নতুন সাবান কিনতেন। এই ঈদে যেটা কিনতেন, পরের ঈদে সেটা কিনতেন না। আব্বার সাবান কেনার এই ব্যাপারটা আমি এখনো ভেবে অবাক হই। ঈদের দিন সকাল বেলা সুগন্ধি যুক্ত নতুন সাবান দিয়ে গোসল করতাম। কি আনন্দ! গোসলের আগে বারবার সাবানের গন্ধ শুকতাম। নতুন সাবান দিয়ে সবার আগে আমিই গোসল করতাম। গোসলের আগে সাবানের মোড়কটা খুলে রেখে দিতাম। মাঝে মধ্যে বের করে সেটার গন্ধ শুকতাম। সারা বছর তো কোনো সুগন্ধি কেনা হতো না। তাই ঈদে কেনা আতর ও সাবানের খোলের গন্ধ যত দিন পারা যায় তা বের করে করে শুকতাম।
নতুন জামা বলতে যা বোঝায় তা ঈদের সময়ই পেতাম। সারা বছর নতুন কোনো জামাকাপড় আমাদের হতো না। তাই নতুন জামাকাপড়ের প্রতি আগ্রহটা একটু বেশিই থাকত। সাধারণত ঈদের দু-চার দিন আগেই আব্বা জামা কিনে আনতেন। নতুন জামা হাতে পেলে কি যে খুশি লাগত। কম দাম, না বেশি দামের জামা, সেটা কোনো ব্যাপার ছিল না। নতুন জামা হলেই হলো। সেই জামা ঈদের দিনের জন্য লুকিয়ে রাখতাম। কিন্তু ঈদের দিন না আসা পর্যন্তু দিনে চার-পাঁচবার জামা বের করে একা একা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। ঈদের দিনে নতুন জামা পরে সবাইকে চমকে দেয়ার জন্য এই লুকোচুরি। কোনোভাবেই ঈদের আগে সেটা পরতাম না।

এখনকার ঈদে কিশোরদের আকর্ষণ মোবাইল ডিভাইসে। অল্প কিছু কিশোর ক্রিকেট খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাদবাকিরা কি নিয়ে যে ব্যস্ত থাকে বোঝা যায় না। আমাদের সময়ে এমন ছিল না। ঈদের এক সপ্তাহ আগ থেকে ব্যস্ত থাকতাম ঈদকার্ড বিতরণ নিয়ে। এখন আর ঈদের সময় ঈদকার্ড তেমন একটা চোখে পড়ে না। আমাদের শৈশবে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য ঈদকার্ড পাওয়া যেত। পাড়ার দোকানে দোকানে ঈদকার্ড বিক্রি হতো। ছোট বড় বিভিন্ন সাইজের ঈদকার্ড। বিভিন্ন রঙের ঈদকার্ড পাওয়া যেত। শহরের অলিতে গলিতে তরুণরা ঈদকার্ডের দোকান দিত। আমরা ঈদকার্ড বিনিময় করতাম। আমি অবশ্য ঈদকার্ড কিনতাম না। বানাতাম। শুকনা গমগাছের সোনালি ডাটা, আর্টপেপার, গাম বা আঁটা, দিয়াশলাইয়ের কাঠি এবং আরো কি সব হাবিজাবি দিয়ে সুন্দর করে ঈদকার্ড বানাতাম। হাতে বানানো ঈদকার্ড দিয়েই আমি বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানাতাম। ঈদকার্ড বানাতে প্রচুর সময় লাগত। মা রেগে যেতেন। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়েও বানাতাম। এ জন্য মায়ের হাতে পিটুনিও খেয়েছি। তবে ঈদের আগে তো! মা খুব একটা বেশি মারতে চাইত না।
ঈদের জামা মানে পাজামা, পাঞ্জাবি আর টুপি। আব্বা আমাদের পাজামা-পাঞ্জাবি কিনে দিতেন ঠিকই। কেন জানি কাপড়ের টুপি কিনে দিতেন না। কিনে দিতেন না! না কি শিশুদের জন্য কাপড়ের টুপি পাওয়া যেত না, তা জানতাম না। আব্বার কাছে পরে শুনেছি, কাপড়ের তৈরি অত ছোট টুপি পাওয়া যেত না। সে কারণে আব্বা আমাদের জন্য কাগজের টুপি কিনে দিত। লাল, হলুদ, খয়েরি, সাদা রঙের কাগজ দিয়ে বানানো হতো সেসব টুপি। এক একটি টুপি দু’তিন রঙের কাগজ দিয়ে বানানো থাকত। দেখতে চমৎকার হতো টুপিগুলো। টুপির আকার খাড়া গোল হতো। কোনো কোনো টুপি দেখতে নৌকার মতো হতো। কাগজের এই রঙিন টুপি কি রকম যে মন কাড়ত, তা বলে বোঝাতে পারব না। কাগজের এই টুপিও আমাদের বয়সী কারো কারো মাথায় থাকত না। ঈদগাহে অনেকেই তাকিয়ে থাকত। এক ঈদে আমাদের দু’ভাইয়ের জন্য বাবা দু’টি টুপি কিনে আনলেন। দু’টি দু’রঙের। আমরা দু’ভাই-ই লালসাদা রঙের টুপিটাকে পছন্দ করলাম। ও যেটা নেবে; আমিও সেটাই চাইলাম। এ নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হলো। শেষে টুপিটি ছিঁড়ে টুকরা টুকরা হলো। মা রেগে দু’জনকে দু’টা চড় মারলেন। ‘নে এবার হলো তো? তোর বাপের তো জমিদারি আছে! আবার টুপি কিনে দেবে; না!’। মা মন খারাপ করলেন। এক দিন পরই ঈদ। শেষে টুপি ছাড়াই ঈদগাহে যেতে হলো।

ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদে আনন্দ অনুভব করতাম। তবে ঈদের পর দিন। আত্মীয় স্বজনরা যখন বাড়িতে বেড়াতে আসত তখন। ঈদের দিনটা আমার মন খুব একটা ভালো থাকত না। জবাই। রক্ত। গরু-ছাগলের ছটফটানি। চামড়া ছাড়ানো। হাড়হাড্ডি থোরা। থরে থরে গোশত কাটা। এসব আমার কাছে খুব কষ্টের মনে হতো। জবাইয়ের সময় ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া। গরু-ছাগলের গোঙ্গানির শব্দ শুনে খানিকটা ভয়ই পেতাম। বাবা বলতেন, ভয় কি রে পাগল! আল্লাহ মানুষের জন্য এসব নির্দেশ দিয়েছেন। আমি ভয় পেতাম। ভয় জিনিসটা কি সেটা বুঝতাম। কিন্তু নিষ্ঠুরতা শব্দটা বুঝতাম না। বাবা বলতেন, ‘এটা নিষ্ঠুরতা নয়। এসব পশুকে মানুষের খেদমতে সৃষ্টি করা হয়েছে। পশুরা আল্লাহর জন্য নিবেদিত।’ আমি অত কিছু বুঝতাম না। এ টুকু বুঝতাম; এ কঠিন বাস্তবতা। বড় হয়েছি। এখনো এ বিষয় নিয়ে ভাবতে পারি না। ভাবতে চাইও না। কোনো ব্যাখ্যা নেই। আল্লাহর নির্দেশ, তাই করি। আল্লাহকে মানলে আর দ্বিতীয়বার এ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ নেই।
কোরবানির ঈদে একবার একটা ঘটনা ঘটল। সবাই বলাবলি করছে, কোরবানির গরু কেনা হয়ে গেছে।

এ কথা শুনে আমার কৌতূহল হলো; কোরবানির গরু দেখতে কেমন হয়। সাত ভাগে গরু কেনা হয়েছে। অন্য এক ভাগির বাড়িতে কোরবানির গরু রাখা হয়েছে। আমার জিদ। আমি কোরবানির গরু দেখতে কেমন! সেটা নিজের চোখে দেখব। আব্বা এক দিন সকালে কোরবানির গরুর কাছে নিয়ে গেল। বলল; এটাই সেই কোরবানির গরু। আমি অবাক! এ তো সাধারণ গরু! আমাদের বাড়িতে যেমন গরু আছে তেমনই গরু। আমি ভেবেছিলাম, কোরবানির গরু বুঝি অন্য রকমের। আমার এই নির্বুদ্ধিতা দেখে সেদিন সকালে কোরবানির গরুকে ঘিরে ধরা সবাই হো হো করে হেসেছিল।

কোরবানির ঈদের পাঁচ-সাত দিন আগে উঠানে বসে আমি আমার হাত-পায়ের নখ কাটার চেষ্টা করছি। আব্বা সেটা লক্ষ করেছেন। কাছে এসে আমার হাত থেকে চাকুটি নিয়ে বললেন, জিলহাজ মাসের চাঁদ ওঠেছে। এখন আর চুল দাড়ি মোচ, হাত-পায়ের নখ কাটা যাবে না। কোরবানির পশু জবাই হবে তারপর। আমি বাবাকে বললাম, কোন দিন চাঁদ উঠেছে? আমি যে চাঁদ ওঠা দেখলাম না? আব্বা মুখে হাসির রেখা টেনে বললেন, কয়েক দিন আগে উঠেছে। সে দিনের চাঁদ ওঠা, হাত-পায়ের নখ, চুল দাড়ি মোচ না ছাঁটার ব্যাপারটি ভাবলে আজও অদ্ভুত লাগে।
আমাদের গ্রামের সব মানুষই ছিল কৃষক। স্বল্প আয়। নিম্নবিত্ত। দরিদ্র। দু-এক ঘর ছিল মধ্যবিত্ত। উচ্চবিত্ত; বড় ব্যবসায়ী; বড় চাকরিজীবী কেউ ছিল না। এখন অবস্থার সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সভ্যতা সেভাবে প্রবেশ করেনি। মানুষ পরিশ্রমী। আয়-রোজগারে ভেজাল কম। সততার বালাই নেই। প্রতিহিংসা পদে পদে। শিক্ষা-দীক্ষায় গ্রামটি পেছনে। গ্রামের মানুষগুলো দারিদ্র্যতার সাথে যুদ্ধ করতে করতেই ক্লান্ত। বেশির ভাগ মানুষেরই ছিল দু’মুঠো ভাতের চিন্তা। ঈদের সময় এই মানুষগুলো বিড়ম্বনায় পড়ত। স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি ফোটাতে পারত না। ব্যর্থ হয়ে নিজেদের মুখটাকে মলিন করে ফেলত। আমার সমবয়সী টুটুল, রাহাত, সানি, খালিদ, মরিয়ম, বেনু ঈদের সময় মন খুলে হাসতে পারত না। ঈদের দিন আব্বা আমার হাতে কিছু টাকা দিত। বলত, ওদেরকে দু’টাকা করে দিতে। আমাদেরও তো বেশি টাকা ছিল না। আমি ওদেরকে ডেকে ডেকে টাকা দিতাম। ওরা খুশি হতো। আমারও আনন্দ লাগত। ওদের আব্বারা দারিদ্র্যের কাছে পরাস্ত হয়ে, ওদের সাথে রাগ করত। বাড়িতে নেমে আসত নীরবতা, বিষণœতা। গ্রামের উপর দারিদ্র্যতার এই থাবা আমি দেখেছি। অল্প বুঝতাম। তবে বুঝতাম। সবাই কেন জানি জোর করে করে হাসতে চাইত। আমি দেখেছি, অনেক বাড়িতেই শুধু পানি মুখে দিয়ে ইফতার হয়েছে। এটিই ছিল আমাদের গ্রামের বাস্তবতা। ঈদ এলে মানুষ আনন্দ করে। কিন্তু আমাদের গ্রামের বড়রা ঈদের আগমনকে অপ্রত্যাশিত বেদনা ভেবে নিরস্ত হতো। গ্রামের এই কষ্টটা এখনো আমাকে বিমর্ষ করে। এভাবে ক্লান্তি আর অবসাদের মধ্যেই আমাদের গ্রামে ঈদের আমেজটা কেটে যেত। এ জন্য ঈদ শুধু আনন্দই আনে না; অনেকের জীবনে বেদনাও বয়ে আনে ।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

নামাজের সময়সূচী

  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৪:৩৭
  • ১২:২৯
  • ৫:০১
  • ৭:০১
  • ৮:২০
  • ৫:৫৪