সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের বেঙ্গালুরুতে তরুণীকে বিবস্ত্র করে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ওই ঘটনার পর থেকে ভারতে ৬ জনকে ও বাংলাদেশে ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতাররা নারী পাচারের ভয়ংকর তথ্য দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। প্রশাসনের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যে তরুণীরা এসব ঘটনার ভিকটিম হন, তারা সাধারণত লোভী প্রকৃতির। তাদের কেউ, টিকটক স্টার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে প্রলুব্ধ হন, বিদেশে ভালো বেতন চাকরির অফারে প্রলুব্ধ হন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের ছবি-ভিডিওতে অধিক সংখ্যক লাইক-কমেন্ট পেতে এমন কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, আবার তাদের কেউ কেউ টাকার লোভে পড়ে এই চক্রের কর্মকাণ্ডে গা ভাসিয়ে দেন।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে তরুণী পাচারের ঘটনা আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। যেসব হোটেল ও রিসোর্ট ‘পুল পার্টি’ বা ‘হ্যাং আউট পার্টি’ হয়েছে সেগুলোর খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে যেন পার্টির নামে অশ্লীল নৃত্য বা মদের আসর না বসতে পারে সে বিষয়টি আমলে নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে ভারতে পাচার হওয়া এক কিশোরী সম্প্রতি দেশে ফিরে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেছেন। এরপর ওই মামলায় তিনজনকে গতকাল মঙ্গলবার সাতক্ষীরা থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে মেহেদি হাসান বাবু (৩৫) মামলার বাদী ওই কিশোরীসহ এক হাজারের বেশি নারীকে ভারতে পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছেন তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ।
গ্রেফতার অপর দুই আসামি মহিউদ্দিন ও আবদুল কাদের মামলার বাদী ভুক্তভোগীসহ পাঁচ শতাধিক নারীকে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় একটি কক্ষে রাখতে সহায়তা করেছেন।
মো. শহিদুল্লাহ আরও বলেন, ‘টিকটক দেশে জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে উঠতি বয়সী মেয়েদের স্টার হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এ কাজে নিয়ে যান। টিকটকের মাধ্যমে এ মেয়েগুলোর পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য টিকটককে আমরা নেগেটিভলি দেখছি। নিম্নবিত্তের বখে যাওয়া ছেলেমেয়েরাই এখানে যুক্ত হচ্ছে।’
পাচার হওয়া ভুক্তভোগীর সঙ্গে আসামি টিকটক হৃদয়ের পরিচয় ২০১৯ সালে হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজে। টিকটক ‘তারকা’ বানাতে চেয়ে বা ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তরুণীটিকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে হৃদয় বাবু।
এরপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০ থেকে ৮০ জনকে নিয়ে ‘টিকটক হ্যাংআউট’ করেন হৃদয়। এরপর একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০ থেকে ৮০০ তরুণ-তরুণীকে নিয়ে ‘পুল পার্টির’ আয়োজন করে হৃদয়।
অবশেষে ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বাউল লালন শাহের মাজারে আয়োজিত টিকটক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় এ মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েন পালিয়ে আসা তরুণী।
ভারতে পাচারের পর ভুক্তভোগীকে বেঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায় কয়েকটি বাসায় পর্যায়ক্রমে রাখা হয়। পালিয়ে আসা তরুণীটি এ চক্র কর্তৃক পাচার করা আরও কয়েকজন বাংলাদেশি ভুক্তভোগীকে সেখানে দেখতে পান। তাদের সুপারমার্কেট, সুপারশপ ও বিউটি পারলারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে।
বেঙ্গালুরুতে পৌঁছার কয়েক দিন পরই ভুক্তভোগীকে চেন্নাইয়ের ওওয়াইও হোটেলে ১০ দিনের জন্য পাঠানো হয়। অমানবিক শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতনের পর সামান্য দয়া ও করুণাও দেখাননি এ চক্রের সদস্যরা। বরং কৌশলে নেশাদ্রব্য খাইয়ে কিংবা জোরপূর্বক বিবস্ত্র অবস্থার ভিডিও ধারণ করে পরিবারের সদস্য ও পরিচিত ব্যক্তিদের কাছে তা পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখা হয় ভুক্তভোগীকে।
অবশেষে ভারতে পাচারের ৭৭ দিন পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওর ঘটনার ভুক্তভোগীর সহযোগীতায় আস্তানা থেকে এ তরুণী পালিয়ে আসেন।
Leave a Reply