করোনা ভাইরাস সংক্রমণের হটস্পট এখনো ময়মনসিংহ বিভাগ। কিছুদিন কম থাকলেও সম্প্রতি বেড়েছে আক্রান্তের হার, মৃত্যুর সংখ্যা, ঝুঁকি ও আতঙ্ক। এ বিভাগের প্রধান করোনা ডেডিকেটেড প্রতিষ্ঠান ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ (মমেক) হাসপাতাল। হাসপাতালের করোনা ইউনিটে করোনা ও উপসর্গ নিয়ে গত জুলাই মাসে মোট ৪৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৬ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে করোনায় ৮ জন এবং উপসর্গ নিয়ে ৮ জন মারা যান। একই সময়ে ময়মনসিংহ জেলায় ৬৫২টি নমুনা পরীক্ষা করে রেকর্ড ৪১ দশমিক ৪১ শতাংশ করোনা রোগী শনাক্ত বলে জানিয়েছেন জেলা সিভিল সার্জন।
ময়মনসিংহ বিভাগে প্রতিদিনই করোনা রোগী বাড়ছে। মমেক হাসপাতালে প্রতিদিনই করোনা আক্রান্ত ও করোনার উপসর্গ নিয়ে রোগী আসছে। এখানে আইসিইউ শয্যা এখন সোনার হরিণ। এ ছাড়া সাধারণ শয্যার জন্য রোগী ও স্বজনদের মাঝে চলছে হাহাকার। এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জনবল সংকটের কারণে হাসপাতালে শয্যা বাড়াতে পারছে না।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার বাইরে বের হওয়া সবাইকে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করলেও অধিকাংশ মানুষই মাস্ক পরছে না। সংক্রমণ কমাতে না পারলে অবস্থা ভয়াবহ হবে। জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলা হাসপাতালে বৃহৎ সিলিন্ডারের মাধ্যমে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ ও আইসিইউ সেবা চালু করতে হবে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য বিভাগ সংক্রমণ কমাতে ভূমিকা রাখতে না পারলে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে। তখন চিকিৎসাসেবায় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা চিকিৎসক নেতাদের।
নেত্রকোনা সদরের করোনা রোগী আবদুল আজিজের স্বজন আবদুল কুদ্দুছ জানান, উন্নত চিকিৎসার জন্য তার রোগীকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলে ভর্তি করা হয়েছিল। অনেক কাকুতি-মিনতি করেও তার রোগীর জন্য আইসিইউ তো দূরের কথা, সাধারণ শয্যাও পায়নি। হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সের সংখ্যা অনেক কম। ফলে কাক্সিক্ষত সেবা মিলছে না। হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নিয়ে অবশেষে গতকাল তার রোগী আবদুল আজিজ (৭০) মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (মমেকহা) করোনা ইউনিটের মুখপাত্র ডা. মহিউদ্দিন খান মুন জানান, হাসপাতালে ২৪টি আইসিইউ সুবিধা এবং ২৩০টি শয্যা নিয়ে করোনা ইউনিট চালু রয়েছে। গতকাল এ ইউনিটে রোগী ভর্তি ছিল ৪৯০ জন। শয্যা না পাওয়া অনেক রোগীর চিকিৎসা চলছে মেঝেতে। কোভিড রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালের সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীদের ওপরও প্রচুর প্রেসার যাচ্ছে।
ডা. মুন জানান, ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা এবং পার্শ্ববর্তী গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জসহ কমপক্ষে ১০ জেলার করোনা রোগীরা ভিড় করছে মমেক হাসপাতালে। অথচ জেলা হাসপাতালগুলোর করোনা ইউনিটে শয্যা খালি পড়ে আছে। তিনি আরও জানান, মমেক হাসপাতালে শয্যা বাড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যেই কয়েকটি ওয়ার্ড খালি করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ডাক্তার-নার্সের জন্য চাহিদাপত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেরণ করা হয়েছে। লোকবল পেলেই আরও শয্যা বাড়ানো যাবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, মমেক হাসপাতালে রোগীর চাপ কমাতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে। গত ৩০ জুলাই হাসপাতালের সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ায় আইসিইউ ও সাধারণ কোভিড ওয়ার্ডে অক্সিজেনের কাক্সিক্ষ প্রেসার পাওয়া যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় রাতে বিকল্প হিসেবে সেন্ট্রাল লাইনের পাশাপাশি ওয়ার্ডগুলোতে সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সেবা দেওয়া হয়। আপ্রাণ চেষ্টা করে আইসিইউতে সিপ্যাপ ও বাইপ্যাপ মেশিনের মাধ্যমে অক্সিজেন সেবা চালু রাখা হয়েছে। অক্সিজেনের প্রেসার বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিজস্ব উদ্যোগে শুরু করা এ প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজিএইচএস) ও ইউনিসেফ আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে।
বিএমএ ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভাপতি ডা. মতিউর রহমান ভূঁইয়া বলেন, মানুষ লকডাউন মানছে না। প্রশাসনের কড়াকড়ি সত্ত্বেও অসংখ্য মানুষ মাস্কবিহীন বাইরে অযথা ঘোরাফেরা করছে। স্বাস্থ্য বিভাগও করোনা সংক্রমণ কমাতে কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করছে না। তিনি আরও বলেন, ময়মনসিংহ সদরে বিশেষ করে সিটি করপোরেশন এলাকায় কোভিড ১৯ রোগী ও উপসর্গ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছেই। ময়মনসিংহের একমাত্র চিকিৎসাকেন্দ্র মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীর সংখ্যা ও করোনায় মৃত্যু বাড়ছে। যতই শয্যা ও আইসিইউ বাড়ানো হোক, আক্রান্তের সংখ্যা না কমাতে পারলে হাহাকার বাড়বে। অক্সিজেন সংকট অবশ্যম্ভাবী। চিকিৎসক সংকটও দেখা দিয়েছে। সচেতনতা বাড়াতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিধিনিষেধ মানাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও মনযোগী হতে হবে। এন্টিজেন টেস্ট বহুগুণ বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও জনপ্রতিনিধিরা নিজেরা মাস্ক পরে কর্মীদের উৎসাহিত করতে হবে।
ময়মনসিংহ জেলার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, সরকার সঠিক পথে আছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এ করোনা অতিমারী মোকাবিলায় সচেতন হতে হবে। প্রত্যেক মানুষেরই স্বাস্থ্যবিধি মানা উচিত। যে কোনো মূল্যে সংক্রমণ কমাতে সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
Leave a Reply