1. iamparves@gmail.com : admin :
  2. janathatv19@gmail.com : Shohag Khan : Shohag Khan
  3. hdtariful@gmail.com : Tariful Rumon : Tariful Rumon
মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ০৮:২৫ অপরাহ্ন

আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ

সৈয়দ আবদাল আহামদ
  • প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ। এ-সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গেজেট প্রকাশের পর নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধনও স্থগিত করে দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের পক্ষে অলৌকিক কোনো সিদ্ধান্ত না হলে আসন্ন নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ ছাড়াই হবে, এটা একপ্রকার নিশ্চিত। এই পরিণতির জন্য দলটির ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমই প্রধানত দায়ী। গত পনেরো বছর শেখ হাসিনার নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগকে ছিটকে পড়তে হয়েছে।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রথমে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। তবে এ ব্যাপারে ছাত্ররা ছিল আপসহীন। তাদের যুক্তি ছিল, আওয়ামী লীগ দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে, আগে তার বিচার হতে হবে। ছাত্ররা তাই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনার সামনে জমায়েত করেছে, শাহবাগ মোড়ে ব্লকেড এবং সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ছাত্রদের চাপেই অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপি-জামায়াতসহ সবগুলো রাজনৈতিক দলও সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ও সাংবাদিক গণমাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। তারা বলতে চেয়েছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড যে প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বিবিসিকে বলেন, তিনি মনে করেন, যে প্রক্রিয়ায় এবং যেভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বরং ফিরে আসার পথ সহজ করবে।

এ ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসা সময়সাপেক্ষ হবে। কারণ আওয়ামী লীগের নির্যাতন ও দুঃশাসনের স্মৃতিটা এত প্রবল, এত জীবন্ত যে, সহসা ‘কামব্যাক’ করা সম্ভব হবে না, যদি না এখনকার সরকার বা পরবর্তী সরকার ব্যর্থ হয়। নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় আনাকে সমর্থন করেছেন। তার মতে, “আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে, রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগমূলক ক্ষমতার অপব্যবহার করে, রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে এদেশে একটি লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। আবার এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অপরাধের বিরুদ্ধে সংগঠিত গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে দমন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য লীগ সরকার মাত্র তিন সপ্তাহে দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেছে এবং ২০ হাজার মানুষকে গুলি করে তাদের অনেককেই চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছে। এমন একটি রাজনৈতিক দলের স্বৈরতান্ত্রিক নেতা-নেত্রীসহ খোদ সেই দলটিকেও ‘সংগঠন হিসেবে’ বিচারের আওতায় আনাকে আমি একটি ন্যায্য পদক্ষেপ হিসেবেই গণ্য করি।”

সাংবাদিক মাসুদ কামাল টিভি টকশোতে অংশ নিয়ে তার মতামত দেন, ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ও গত পনেরো বছরের আওয়ামী লীগ এক নয়। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগকে তখন ফ্যাসিবাদী বলা হয়নি। ফ্যাসিবাদ হয় নেতৃত্বের কর্মকাণ্ডের কারণে। এ জন্য বিচার হবে যিনি ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন, সেই ব্যক্তির। দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে কেন ফ্যাসিবাদের জন্য দায়ী করা হবে? তবে আওয়ামী লীগ যে একটি ফ্যাসিবাদী দল, সে বিষয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন লেখক, গবেষক বদরুদ্দীন উমর ও রাষ্ট্রচিন্তক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ। বদরুদ্দীন উমর স্পষ্টভাবে বলেছেন, আওয়ামী লীগ বরাবরই একটি ফ্যাসিবাদী দল।

শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা বাপ-বেটি দুজনে মিলে বাংলাদেশের ওপর অভিশাপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানে জনগণের অভিশাপ মুক্তি হয়েছে। অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ চরিত্রগতভাবে এবং জিনগতভাবেই একটি ফ্যাসিস্ট দল। বিশেষ করে, বিগত পনেরো বছর জগদ্দল পাথরের মতো বাংলাদেশের ওপর চেপে বসেছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ।

শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ভারত থেকে দেশে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। পঁচাত্তরের পর তিনি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। আওয়ামী লীগে তার ৪৪ বছরের রাজনীতিতে তিনি ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে ২০২৪ চার মেয়াদে ২০ বছর জবরদস্তিমূলকভাবে ক্ষমতায় ‍ছিলেন। কী ক্ষমতায়, কী ক্ষমতার বাইরে জনগণ শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী রূপই দেখতে পেয়েছে। তেমনি শেখ মুজিব সেই পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই মানুষ তাকে প্রত্যক্ষ করেছে একজন ফ্যাসিস্ট রাজনীতিক হিসেবে।

ফ্যাসিস্ট, ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ

‘ফ্যাসিস্ট’ ও ‘ফ্যাসিবাদ’ এখন বাংলাদেশে বহুল আলোচিত বিষয়। ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিজমের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয় জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনিকে। ইতিহাসে এ দুজন শাসক ফ্যাসিস্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। এদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিভিন্ন দেশে যুগে যুগে আরো ফ্যাসিস্ট শাসক বা ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশে শেখ মুজিব ও তার মেয়ে শেখ হাসিনা তাদের দল আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসন চালিয়ে জনগণের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। শেখ মুজিবের ফ্যাসিবাদী শাসনের বড় নজির ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত সাড়ে ৩ বছরের শাসনকাল। আর শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বড় নজির ২০০৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত শাসনকাল। ফ্যাসিবাদের কারণে দুজনেরই পতন হয়েছে খুব করুণভাবে।

ফ্যাসিস্টরা সাধারণত রাষ্ট্রক্ষমতায় একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করেন। হিটলার জার্মানিতে ক্ষমতা নেওয়ার পর শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতাই নিয়ন্ত্রণ করেননি, রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারা বড় সমাবেশ করে তার শক্তির প্রদর্শন করতেন। এক ব্যক্তির সর্বময় কর্তৃত্ব ও শাসনের বাইরে কোনো কথা বলার সুযোগ ছিল না। হিটলার ও মুসোলিনি যেটা মনে করতেন, সেটাই সবাইকে জানতে হতো। ফ্যাসিস্টরা তাদের সমালোচনার জবাব দিতেন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। অন্যের ওপর দোষ চাপাতে তারা কাউকে না কাউকে বলির পাঁঠা বানাতেন।

বিবিসির এক রিপোর্টে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লরেন্স ব্রিটের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ফ্যাসিবাদের ১৪টি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতীয়তাবাদের ক্রমাগত প্রচার, মানবাধিকার হরণ, সশস্ত্র বাহিনীকে সুবিধা দেওয়া, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, করপোরেট স্বার্থ রক্ষা করা এবং প্রহসন ও প্রতারণার নির্বাচন। যারা ফ্যাসিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাস করে, তারা প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে গ্রাহ্য করে না। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য তারা এমন নির্বাচনের আয়োজন করে, যেখানে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার শাসনকাল পর্যালোচনা করলে এরই প্রমাণ পাওয়া যায়।

শেখ মুজিবের শাসনকালে ফ্যাসিবাদ

প্রথমা থেকে প্রকাশিত ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইতে সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ লেখেন, ‘১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়কে নষ্ট করিয়া দেওয়ার জন্য সবার চেয়ে বেশি ও আশু দায়ী ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের একগুঁয়েমি। ১৯৫৫ সালে যুক্তফ্রন্ট ভাঙিয়া দেওয়ার মূলেও ছিল শেখ মুজিবের কার্যকলাপ। যুক্তফ্রন্ট ভাঙিয়া তিনি পূর্ববাংলার বিপুল ক্ষতি করিয়াছেন। যুক্তফ্রন্ট ভাঙা যদি দোষের হইয়া থাকে, তবে সে দোষের জন্য মুজিবুর রহমানই প্রধান দায়ী।’

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অন্ধভক্ত ছিলেন শেখ মুজিব। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী মুজিবের এই একগুঁয়েমি ও দম্ভ পছন্দ করতেন না বলে উল্লেখ করেন আবুল মনসুর আহমদ।

১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী হত্যার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে দায়ী করা হয়। সেদিন সরকার ও বিরোধীদলীয় সদস্যদের হট্টগোল এবং মারামারির একপর্যায়ে আক্রান্ত ও গুরুতর আহত হয়ে শাহেদ আলী হাসপাতালে মারা যান। এরপরই আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হয়।

তৎকালীন মন্ত্রী ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হাশিমুদ্দিন আহমদের সাক্ষাৎকারে (আমি শাহেদ আলী হত্যা দেখেছি, রক্তাক্ত অবস্থায় পুলিশ শাহেদ আলীকে নিয়ে যেতে দেখেছি, ইনকিলাব, ২২ এপ্রিল, ১৯৯৮ উল্লেখ করা হয়, “সেদিন অ্যাসেম্বলিতে ঢোকার সময় শেখ মুজিব ও মুসলিম লীগ নেতা মোহন মিয়া ধস্তাধস্তি করছিল।

এরপর শুরু হয় হট্টগোল। একটা পেপারওয়েট সজোরে নিক্ষিপ্ত হয় শাহেদ আলীর ওপরে। চেয়ার ছোড়াছুড়ি মাইকের ডান্ডা ভেঙে নিক্ষেপ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ তো হচ্ছেই। শেখ মুজিব হাউস শান্ত করার বদলে গরম করছিলেন। মুজিবের হাতে একটা ‘হান্টার’ ছিল। ডেপুটি স্পিকারের দিকে তেড়ে যাওয়ার সময় কে যেন হান্টারটি তার হাত থেকে কেড়ে নেয়।”

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সরকারি দল মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা ভাসানীই দলের নাম দেন আওয়ামী মুসলিম লীগ বা জনগণের মুসলিম লীগ। কিন্তু এ দলে থাকতে পারেননি তিনি। মওলানা ভাসানী এ দল ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর শেখ মুজিব তার মতো করে আওয়ামী লীগকে সাজান। মওলানা ভাসানী ন্যাপ প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে সভা করলে সেই সভা শেখ মুজিবের লেলিয়ে দেওয়া গুণ্ডারা পণ্ড করে এবং ইট মেরে ভাসানীর মাথা ফাটিয়ে দেয়।

গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম এবং বহুবার জেল খেটেছেন শেখ মুজিব। দেশের জন্য একাত্তরের পূর্ববর্তী সময়ে তার অসামান্য ভূমিকাও প্রশ্নাতীত। তবে একাত্তর-পরবর্তী (১৯৭৩-৭৫) সাড়ে ৩ বছরে তার ফ্যাসিবাদী শাসন দেশ এবং দেশের মানুষকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে স্বাধীন বাংলাদেশে এসে মুজিব স্বৈরাচারী মূর্তিতে আবির্ভূত হন। একনায়কত্ববাদী এবং ডিক্টেটর মানসিকতায় তিনি পুষ্ট ছিলেন। তার অহমিকা ও দম্ভ সবকিছু ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বিরুদ্ধমত দমনে দলীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করে চালানো হয় নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন-নির্যাতন। জাসদের মতো একটি রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম ও বিকাশ আওয়ামী লীগ মেনে নিতে পারেনি।

ফ্যাসিবাদী শাসনের নিকৃষ্ট উদাহরণ রাজনৈতিক হত্যা। তখনকার সরকারি রেকর্ড মতেই ৩৭ হাজার রাজনৈতিক কর্মী, শ্রমিক, নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ‘লা ফ্যাসিজম’ বইয়ে ফ্যাসিস্ট সম্পর্কে জি প্রজোলিনী লিখেছেন, ‘ফ্যাসিস্টরা সশস্ত্র বাহিনী রূপে চলাফেরা করতে পারত, খুশিমতো হত্যা করতে পারত। তারা নিশ্চিত যে পুলিশ তাদের কিছু করবে না।’ শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ আমলে অবস্থাটা হুবহু এ রকমই ছিল। বামনেতা প্রয়াত হায়দর আকবর খান লিখে গেছেন, ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাড়ে ৩ বছরের রাজত্বকালে কয়েক হাজার দেশপ্রেমিক বামপন্থি কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। জাসদ গঠনের পর সরকারি গুণ্ডাবাহিনী জাসদ নেতা সিদ্দিক মাস্টারকে প্রথম হত্যা করে, এরপর জাসদ নেতা অ্যাডভোকেট মোশাররফ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস রোকনকে হত্যা করে।’

বিপ্লবী সিরাজ সিকদার হত্যার পর সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব দম্ভভরে হুংকার দিয়েছিলেনÑ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’ ‘নক্সাল দেখলেই গুলি করো’Ñতার এই নির্দেশের হাজারো অপব্যবহার ঘটেছে বাংলাদেশে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আড়ালে জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে প্রতিষ্ঠা (১৯৭২ সালের ৭ মার্চ রক্ষী আদেশ প্রণয়ন করে ১ ফেব্রুয়ারি ৭২ থেকে কার্যকর গণ্য করা হয়) করা হয় শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে। রক্ষীবাহিনীর নির্দয় অপারেশনের বিবরণ আছে আহমেদ মুসার ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ’ বইয়ের পরতে পরতে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ইকোরাটিয়া গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক আবদুল আলী আহমেদ মুসাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার ছেলে রশিদকে রক্ষীবাহিনী হাত-পা বেঁধে কীভাবে মারল তার বিবরণ দেন। বইয়ে ছাপা হওয়া সাক্ষাৎকারে আবদুল আলীর মর্মস্পর্শী বিবরণ : ‘রক্ষীবাহিনী রশিদকে হাত-পা বেঁধে আমার চোখের সামনে গুলি করল। ঢলে পড়ল বাপ আমার।

একটা কসাই আমার হাতে একটা কুঠার দিয়ে বলল, তোর নিজের হাতে ছেলের গলা কেটে দে, ফুটবল খেলব ওর মাথা দিয়ে। আমার মুখে রা নেই। না দিলে বলল ওরা, তোরও রেহাই নেই। কিন্তু আমি কি তা পারি? আমি যে বাপ। একটানা দেড় ঘণ্টা মারার পর আমার বুকে ও পিঠে বন্দুক ধরল। শেষে নিজের হাতে কেটে দিলাম ছেলের মাথা। আল্লাহ কি সহ্য করব, বলেন বাবা?’

খুন, সন্ত্রাস, নির্যাতন-নিপীড়ন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, কালোবাজারি, মজুতদারি, লালবাহিনী, মুজিব বাহিনীর দৌরাত্ম্য এবং পরে দুর্ভিক্ষÑএক দুঃসহ বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম হয়েছিল একাত্তর-পরবর্তী মুজিব শাসনামলে। পঁচাত্তরে বাকশাল কায়েম করে, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করে একদলীয় শাসন চালু করেন মুজিব। আর এই ফ্যাসিবাদী শাসনই তার পতনকে ত্বরান্বিত করে।

শেখ হাসিনার শাসনকালে ফ্যাসিবাদ

আওয়ামী লীগকে শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৪ বছর। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ফিরে আসে। ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অধীনে সবচেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জয়লাভ করে। কিন্তু এই নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে বলে অভিযোগ করেন শেখ হাসিনা। তিনি ঘোষণা করেন, ক্ষমতায় খালেদা জিয়াকে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেবেন না। তিনি কথা রেখেছিলেন।

খালেদা জিয়া এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে দেশ চালাতে পারেননি। সে সময় ১৭৩টি দিন হরতাল ও ‘জ্বালাও-পোড়াও’ করেছে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। মেয়র মহিউদ্দীনকে দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর অবরোধ এবং ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে বন্দরকে ছারখার করে দেওয়া হয়। খালেদা জিয়া অর্থনীতিকে ইমার্জিং টাইগারে পরিণত করেছিলেন। বিদেশি বিনিয়োগ আসছিল দেশে। কিন্তু শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক আন্দোলনের কারণে তা নস্যাৎ হয়ে যায়।

তখন হাসিনার নির্দেশে গান পাউডার দিয়ে যাত্রী বাস জ্বালিয়ে দিয়ে ১৫ জন মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে লগি-বইঠার তাণ্ডব হয়েছিল। সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। মনি বেগমের মতো নারীকে প্রকাশ্যে রাজপথে বিবস্ত্র করা হয়েছিল। সচিবালয়ের কর্মকর্তাকে রাজপথে দিগম্বর করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেও শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ড চালান। ধর্ষণের সেঞ্চুরি উৎসব হয় ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে ছররা গুলিতে রক্তাক্ত করা হয়। আবার সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার মন্ত্রী নাসিম ঘোষণা দেন সাদেক হোসেন খোকা গরুর লাল রক্ত গায়ে মেখেছেন। হাইকোর্টের সামনে বস্তি বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বিচারকদের উদ্দেশে লাঠি মিছিল করা হয়েছিল।

কিন্তু এসব কিছুকেও ছাড়িয়ে যায় ২০০৯-২৪ শেখ হাসিনার কর্তৃত্বপরায়ণ পনেরো বছরের শাসনকাল। ওই সময় গণতন্ত্র নির্বাসনে চলে যায়। বিচারের বাণী কাঁদতে থাকে নীরবে নিভৃতে। সুশাসন বলে কোনো শব্দের অস্তিত্ব ছিল না দেশে। তিনটি ভুয়া নির্বাচন দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। মামলা-হামলা, গুমের বিভীষিকা, খুন, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, গণহত্যা, স্বৈরতন্ত্র, দলীয় ব্যবসায়ীদের দিয়ে ব্যাংক ডাকাতি অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার এক নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে দেশে।

আওয়াজ ওঠে, যোগ্য বাবার যোগ্য কন্যা। ফ্যাসিবাদে পিতা শেখ মুজিবকে ছাড়িয়ে যান শেখ হাসিনা। দেশে একটির পর একটি গণহত্যা চলতে থাকে। পিলখানায় ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। শাপলা চত্বর রঞ্জিত হয় আলেম-ওলামাদের রক্তে। গণহত্যার শিকার হন কমপক্ষে ৩০০ আলেম ও মাদরাসাপড়ুয়া ছাত্র। মাওলানা সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে গণহত্যার শিকার হন আড়াইশোর বেশি লোক।

তেমনি নরেন্দ্র মোদির সফর কেন্দ্র করে চালানো হয় গণহত্যা। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন দমন করতে চালানো হয় গণহত্যা। রাষ্ট্রীয় বাহিনী পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবিকে হত্যাযজ্ঞে ব্যবহার করা হয়। গুলিতে নির্বিচারে হত্যার শিকার হয় নিরীহ ছাত্র-জনতা। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর তদন্ত করে যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে আছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের নির্মম-নিষ্ঠুর বিবরণ। রিপোর্টে ১৪০০ ছাত্র-জনতা গুলিতে হত্যার কথা বলা হয়েছে। ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের বিপ্লবে ২০ হাজার মানুষকে গুলি করে আহত করে তাদের অনেককে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আয়নাঘরে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন, গ্যাং র‌্যাপ, বিশ্বজিৎ, আবরার ফাহাদ ও সাগর-রুনি দম্পতির হত্যাকাণ্ড চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে দেশে।

অবশেষে শেখ হাসিনার এই নগ্ন ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে ৫ আগস্ট ২০২৪। তাকে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হতে হয়। পৃথিবীর যেকোনো রাজনৈতিক দল বা সরকার কর্তৃক জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত এমন হত্যাযজ্ঞ ও সন্ত্রাস সমর্থন করা অন্যায়। এমন অন্যায়ের বিচার করতে না পারলে ফ্যাসিবাদ চলতেই থাকবে। সরকার তাই শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের অপরাধের বিচার করছে। সেই লক্ষ্যেই আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অপরাধের বিচারের জন্য আদালতে এখন বিচারের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেই বিচারের দিকেই দেশ তাকিয়ে আছে।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক

আমার দেশ

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

নামাজের সময়সূচী

  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৪:২২
  • ১২:২৮
  • ৫:০৩
  • ৭:১০
  • ৮:৩৩
  • ৫:৪৩