ময়মনসিংহ প্রতিনিধিঃ
দেখলে মনে হবে যেন বিশাল বড় এক বিল, পুরোটা জুড়েই কচুরিপানা দিয়ে ছেয়ে আছে। তবে সেটা বিল নয়, এটা প্রায় ৩২ হেক্টরের কৃষি ও ধান চাষের জমি। একই সাথে রয়েছে বেশ কিছু ফিসারী ও পুকুর। প্রতি বছর এখানে চাষ করা হয় বুরো, আমন, পেয়াজ, রসুন, মরিচ, আলু, শশা, করলা, লাউ কুমড়াসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি। কিন্তু, এবার আমনের মৌসুমে অপরিকল্পিত ফিসারী ও পুকুর তৈরী করায় ওই জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে সময় চলে গেলেও কৃষকরা ওই জমিতে আমন চাষ করতে পারছেন না।
এমন চিত্রই দেখা গেছে ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের নন্দিগ্রামে। প্রায় ৩২ হেক্টর ফসলের মাঠ আব্বাহরী মাঠ নামে পরিচিত। ওই মাঠের দক্ষিণ পাশে রয়েছে দোয়েল বিল। অতিবৃষ্টিতে আব্বাহরী মাঠে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে দোয়ের বিলে সেই পানি নেমে যেত। গত বুরো ও আমন চাষ ওই জমিতে করতে পারলেও এবার পানি নামার জায়গায় বেকু দিয়ে ফিসারী ও পুকুরের বাধ তৈরী করা হয়। সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। এই জলাবদ্ধতায় প্রায় ১০ থেকে ১৫ টি পরিবার পানি বন্দি হয়ে আছেন দীর্ঘদিন যাবত।
স্বরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, আব্বাহরী ফসলের মাঠে অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে পাশের দোয়েল বিলে পানি নেমে যেত। গত বছরও জলাবদ্ধতা তৈরী হলে আমন ও বুরো চাষ আটকে যায়। পরে স্থানীয়রা এক সাথে বসে ফিসারির পাড় কাটার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কয়েকটি ফিসারীর পাড় কেটে দিলে পানি নেমে যায়। পরে ওই জমিতে আমন, বুরো, সবজি চাষ করেন কৃষকরা। তবে, এই বছর স্থানীয় আবুল হাসেম, দস্তর আলী, জনাব আলী, আব্দুল খালেক, ভুট্রো মিয়াসহ আরও বেশ কয়েক জন ফসলের মাঠ থেকে বিলে পানি নামার জায়গায় বেকু দিয়ে ফিসারী ও পুকুরের বাধ তৈরী করেন। যে কারণে আব্বাহরী ফসলের মাঠের পানি নামছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন কয়েক শতাধিক কৃষক।
এই জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে ৪৯ জন কৃষক গত ৪ আগস্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা মৎস কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েও সমাধান হচ্ছে না। এদিকে, আমন চাষের সময় শেষ হয়ে আসায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। তবে, স্থানীয় প্রশাসন বলছে অচিরেই এই সমস্যার সমাধান করা হবে।
মজিবুর রহমান বলেন, আব্বাহরীতে আমার তিন একর জমি আছে। ওই জমি জমির ধানেই আমার সংসার চলে। গতবারও বুরো, আমন বিভিন্ন সবজি চাষ করেছি। বাঁধের কারণে যে পানি জমেছে তাতে মনে হয়, এবার এই জমিতে ধান লাগাতে পারব না। তবে, ধান লাগাতে না পারলে বউ বাচ্চা নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।
কৃষক আরিফ সরকার বলেন, পানির কারনে প্রাই ৮০০ কাটা জমি পানিতে তলিয়ে আছে। যদি পানি নামার ব্যবস্থা করা হয়। তাহলে আমরা ৮ ০০ কাটা জমির ফসল পাব. এখানে পানি থাকার কারনে প্রায় ৩০০ কাটা জমিতে বিভিন্ন জাতের শাক সবজি ছিল। পানির কারণে সব সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। এই পানি দ্রুত অপসারণের জন্য প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
কৃষক জুয়েল মিয়া বলেন, দোয়ের বিলে অপরিকল্পিত পুকুরের কারনে আমিসহ প্রায় ১০ থেকে ১৫ পরিবার পানি বন্দি হয়েছি। ঘরে, উঠানে, রান্নাঘরে টয়লেটেসহ সব জায়গাতেই পানি। টয়লেটের প্রয়োজনে যেতে হয় অন্যের বাড়িতে। খাওয়া দাওয়া রান্নাবান্না একই অবস্থা। তাছাড়া গরু, ছাগল, হাস মুরগি নিয়েও বিপদে আছি। আমরা এখন নিজ বাড়িতেই পরবাসী। তবে, আমরা এর স্থায়ী সমাধান চাই। এখানে ছোট একটি খাল তৈরী করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে।
কৃষক মোহাম্মদ উজ্জ্বল মিয়া বলেন, অপরিকল্পিত ভাবে ফিসারী, পুকুর তৈরী করার কারনে ৮০০ কাঠা বা ৩২ হেক্টর জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। ওইখানে অনেক পুকুর ছিল, তাও তলিয়ে গেছে। তাছাড়া প্রায় ১০০ কাঠা সবজি চাষ করা হয়েছিল। পানি উঠে সব সবজি পঁচে গেছে।
তিনি আরও বলেন, এই জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে আমরা ৪৯ জন কৃষক গত ৪ আগস্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা মৎস কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু সমাধান হচ্ছে না, তারা বিভিন্ন তালবাহানা করছে। কিন্তু আমরা জমিতে ফসল ফলাতে না পারি। তাহলে বউ বাচ্চা নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।
কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি সেই ছোট থেকেই দেখে আসছি, বৃষ্টি হলে আব্বাহরীর পানি জমলে তা দোয়েল বিলে নেমে যায়। কিন্তু কয়েক বছরে দোয়েল বিল পুরোটাই ফিসারী হয়ে গেছে। তাতেও আব্বাহরী ফসলের মাঠ থেকে পানি নামার জন্য খালের মত ছিল। গতবছর সেটিকেও ফিসারী বানানো হয়েছে। তাই, এবার আর পানি নাম্বার জায়গা নাই। তবে, আমাদের দাবি প্রশাসন যেন একটি খাল করে স্থায়ী সমাধান করে দেয়।
এবিষয়ে ফিসারী করা আবুল হাসেম ও জনাব আলী বলেন, এখনে শুধু আমাদের ফিসারীর কারনে জলাবদ্ধতা তৈরী হয়েছে। তা কিন্তু ঠিক না। এখানে আমাদের মত আরও অনেক চাষী আছে। তারা সবাই যদি পানি নামার রাস্তা দেয়। তাহলে আমরাও দেব।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ কাইয়ুম বলেন, গত বছরও একই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। তবে, সেবার ফিসারী ও পুকুরের বাধ কেটে দিলে কৃষকরা বুরো আমন করতে পেরেছিল। এই বছরও আবারও সেই সমস্যা হয়েছে। আমরা বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করছি।
গৌরীপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুন্নাহার বলেন, বিষয়টি শুনে আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। যারা অপরিকল্পিতভাবে ফিসারী বা পুকুর তৈরী করে এমন সমস্যার সৃষ্টি করেছে তাদের সাথে কথা বলেছি। তাদের তিন থেকে চার দিনের মাঝে বাধ কেটে দিতে বলা হয়েছে। যদি এতে কাজ না হয়, পরবর্তীতে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান মারুফ বলেন, এবিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর সমাধানের জন্য উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও মৎস কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেছেন। এছাড়াও স্থানীয় চেয়ারম্যানকে সমস্যা সমাধান করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তবে, আমন ধান লাগানোর আগেই সমস্যাটি সমাধান করা হবেও আশ্বাস দেন।
এবিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে ইউএনও’কে সমাধান করার জন্য বলা হবে।
Leave a Reply