‘বর্মা আঁরার দ্যাশ। আঁরার গরু, জাগা, ভিটা বেক্কিন পাইলে বর্মা যাইয়ুম।’ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ৬৩ বছর বয়সী মত্তুল হোসেন এভাবেই তার প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা তাদের ওপর নিষ্ঠুর নিপীড়ন চালায়। ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ২০১৭ সালে তারা বাংলাদেশের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেন। প্রায় একই কথা বলেন ২৮ বছর বয়েসী হাফেজ আহমেদ। কুতুপালংয়ে ঘনবসতির কারণে তারা ভাসানচরে খোলামেলা জায়গা পেয়েছেন। সুরক্ষিত ঘরবাড়ি পেয়েছেন।
ভাসানচরে জীবন-যাপনের অবারিত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে রোহিঙ্গারা খুবই খুশি। এখন পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গা ভাসানচরে এসেছেন। মুত্তুল হোসেন জানান, তিনি ও তার স্ত্রী ভাসানচরে এসেছেন। কিছুদিনের মধ্যে তার চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে ভাসানচরে আসবে।
এক লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার লক্ষ্যে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত আবাসনের ব্যবস্থা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে করা হয়েছে। প্রায় ১৩ হাজার একরের ভাসানচরে এক হাজার ৭০২ একর জায়গাজুড়ে রোহিঙ্গাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরও বিস্তির্ণ জায়গায় বৃক্ষরোপণ ও পশু পালনের ব্যবস্থা আছে। এখানে আবাসনের আরও ব্যবস্থা করার সুযোগ আছে। অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হলে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গাকে এই দ্বীপে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।
ভাসানচর প্রকল্পের পরিচালক কমোডর আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলেছেন, এটা সম্পূর্ণ অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো মূল লক্ষ্য। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী দমন-পীড়ন শুরু করলে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ওই বছরের নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের লক্ষ্যে ভাসানচরে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
প্রাথমিকভাবে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয় ধরা হলেও পরবর্তীতে তা বৃদ্ধি করে তিন হাজার ৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দৃষ্টিনন্দন আবাসিক অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। ২০১৮ সাল থেকে জরুরিভিত্তিতে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক পরিশ্রম করে বিশাল আশ্রয়ণ ব্যবস্থার কাজ সম্পন্ন করে। ১২টি ঘর নিয়ে এক একটি ক্লাস্টার নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি ক্লাস্টারে ৭৬৮ জন রোহিঙ্গা বসবাস করতে পারেন।
ভাসানচরে দেখা গেল রোহিঙ্গা ছেলে-মেয়েরা নানা ধরনের খেলাধুলা করছে। একটা খোলা বাজার যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল প্রকার পণ্যের পসরা সাজিয়ে রোহিঙ্গারাই বিক্রি করছেন। মহিষ পালনের ব্যবস্থাও আছে। ক্লাস্টারগুলোর মাঝেও ছোট ছোট রাস্তা আছে। উঁচু লাইট হাউস নির্মাণ করা হয়েছে যা দেখে বঙ্গপোসাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলি ভাসানচরকে চিনতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই লাইট হাউসের নাম রেখেছেন ‘লাইট অব হিউম্যানিটি’। জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য নির্মিত হয়েছে আলাদা ভবন। হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ইতিমধ্যে ভাসনাচরে ৪২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ভাসানচরে ভূগর্ভস্থ পানির গুণগত মান ভালো। চরের ১৭৬ বছরের ঝড় ও বৃষ্টির ইতিহাস পর্যালোচনা করে নির্মাণ করা হয়েছে তিনস্তরের সুরক্ষা বাঁধ। এই বাঁধ সমুদ্রের ঢেউ ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে তীর রক্ষা করবে। ১৯ ফুট উঁচু বাঁধের ভেতরে আরও শক্ত করার জন্য গাছ লাগানো হয়েছে। প্রথম স্তরে সমুদ্রের ঢেউ থেকে সুরক্ষা দেবে। বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের রান্নার জন্যে এলপিজি গ্যাস দেয়া হয়েছে। আছে ফায়ার স্টেশনও। ভাসানচরে আসা রোহিঙ্গারা জানালেন, তারা এই চরে কাজ করতে চান। প্রকল্পটির কর্মকর্তারা বলছেন, এই চরে হাঁস-মুরগি পালন, ধান ও শাক-সবজি চাষ, রাজমিস্ত্রীর কাজ, হস্তশিল্প, কমিউনিটি সার্ভিস প্রভৃতি করতে পারে। এমন কি পর্যটন সুবিধাও করা সম্ভব। রোহিঙ্গাদের এভাবে জীবিকায়নের ব্যবস্থা করা হলে বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের মধ্যে অপরাধের প্রবণতা কমে আসবে। রোহিঙ্গাদের দৈনিক মজুরি কিংবা চুক্তিভিত্তিতে কাজ করতে দেয়া যায়।
জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং হিলিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৪০টি প্রতিনিধি দল ইতিমধ্যে ভাসানচর সফর করেছেন। ৪২টি দেশি এনজিও বর্তমানে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে। সরকার বিদেশি এনজিওকে এখানে কাজ করতে দিতে চায়। এই লক্ষ্যে ভাসানচরের অবস্থা সরেজমিনে অনুধাবন করতে বিদেশি কূটনীতিকদের ভাসানচর দেখানোর ব্যবস্থা করা হতে পারে।
ভাসানচরে অনেক ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা অপরাপর দ্বীপগুলির চেয়ে বেশি। হাতিয়ায় একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে চার হাজার ২০০ লোক এবং সন্দ্বীপে সাড়ে চার হাজার মানুষের আশ্রয়ের সুবিধা থাকলেও ভাসানচরে সমান পরিমাণ আশ্রয়কেন্দ্রে থাকবেন মাত্র এক হাজার মানুষ।
সরকার গত বছরের ৪ ডিসেম্বর প্রথম রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে আসা শুরু করে। রোহিঙ্গা হাফেজ আহমেদ বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে। তাদের আকিয়াব কিংবা ইয়াঙ্গুন যেতে দেয় না। এসব অধিকার তাদের দিতে হবে। ভাসানচরে এখন রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন।
কমোডর আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী আরও বলেন, ভাসানচরে আসাদের মধ্যে ৪ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের সংখ্যা বেশি। এখানে স্থাপনা, পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। এখনও অনেক রোহিঙ্গা আসার জন্য প্রস্তুত আছে। এনজিওরা আরও প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, এখানে কেউ অলস নেই। তারা শিক্ষা পাচ্ছে। দু’একটা এনজিও পাইলট প্রকল্প নিয়েছে। ছোটখাট মাছ চাষ, সবজি চাষ করছে। পর্যায়ক্রমে বড় আকারে যাচ্ছে। স্কুল শুরু করতে পেরেছি। বাংলাদেশের কোনো স্থানে স্কুল শুরু না করলেও এখানে অনানুষ্ঠানিক পাঠদান শুরু করতে পেরেছি।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, কক্সবাজারে ৬৫০০ একর জায়গার ভেতরে অধিক সংখ্যক বসবাসের কারণে তা সহজ করার জন্য অস্থায়ীভিত্তিতে তাদের এখানে আনা হয়েছে। তারা সবাই নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়। এখান থেকেও তারা ফিরে যাবে।
Leave a Reply