১০০ বড় কারবারির তালিকা সিআইডিতে, ১২ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা * প্রতিদিনই নতুন নতুন ইয়াবা কারবারি তৈরি হচ্ছে -এসপি, কক্সবাজার
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১। ভোরের আলো ফোটার পরই স্ত্রী রত্নাকে নিয়ে টেকনাফ থেকে ঢাকা রওনা হন স্বামী মুকুল ব্যাপারী। চেপে বসেন সেন্টমার্টিন পরিবহণের একটি বাসে। পাশাপাশি বসে গুল্প-গুজবে সময় কাটছিল তাদের।
দুজনেই পাকস্থলীতে বহন করছিলেন হালের সবচেয়ে প্রচলিত নেশার বড়ি ইয়াবা। যা অন্য যাত্রীরা কল্পনাও করতে পারেননি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আটকা পড়েন গোয়েন্দা জালে।
পরে জিজ্ঞাসাবাদে মুকুল জানিয়েছেন, ২৫শ ইয়াবা ঢাকায় এনে পৌঁছে দিলেই তারা পেতেন ২৫ হাজার টাকা। আর পুরো চালানের দাম ব্যাংকিং চ্যানেলেই চলে যেত মহাজনের হাতে। নিষিদ্ধ ইয়াবা কারবারি (মহাজন) টেকনাফের কোটিপতি মনিউল্লাহ মনিরকে অল্প সময়ে বিত্তশালী হতে দেখে তারাও নামেন এ কারবারে।
তাদের মতে, ইয়াবা কারবারিদের হাতে আছে ‘আলাদিনের চেরাগ।’ যারাই ১-২ বছর ইয়াবার পাইকারি কারবার চালাতে পেরেছেন তারাই বনে গেছেন বিত্তশালী।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ বা ডিবি) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট বা সিআইডি) মানি লন্ডারিং ইউনিটের কর্মকর্তারা বলেছেন, ইয়াবা কারবার করে রাতারাতি অর্থ-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে গেছেন অনেকেই। এরপর টাকার জোরে ক্ষমতা, প্রভাব, প্রশাসনিক দাপট, রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে এলাকায় আলাদা সাম্রাজ্যও গড়ে তুলছেন তারা। ইয়াবার পাইকারি কারবারিদের অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় জনপ্রতিনিধির চেয়ারেও বসেছেন। ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে স্বল্প সময়ে কোটিপতি হয়ে উঠার অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্ম্য চলছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
ডিবির উপকমিশনার (উত্তর) মশিউর রহমান বলেন, যে কোনো উপায়ে ইয়াবা কারবারিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে ভয়াবহ বাস্তবতা অপেক্ষা করছে। এর মাশুল দিতে হবে সবাইকে। ইয়াবার বিস্তার ঠেকাতে সমন্বয়ের মাধ্যমে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারে জোর দেন তিনি।
পুলিশ ও র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া ইয়াবা কারবারিদের নাম-ঠিকানা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে গাড়ি চালক, হেলপার, দিনমজুর, মুদি দোকানি, বেকার-বখাটে, দেহ ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ইয়াবা কারবারের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। রাতারাতি বিত্তশালী হওয়ার নেশায় এ কারবারের ব্যপ্তি বাড়ছে।
যারা জড়িত : সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপারের অফিস থেকে ১০০ বড় ইয়াবা কারবারির একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটে। তালিকাটি পাওয়ার পর প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই শেষে ১২ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়। জব্দ করা হয় তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট।
যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তারা হচ্ছে- আব্দুল শুকুর, আমিনুর রহমান ওরফে আব্দুর আমিন, শফিকুল ইসলাম, ফয়সাল রহমান, নূরুল হুদা, এনামুল হক, মো. একরাম, আব্দুর রহমান, নূরুল কবির, জামাল হোসেন, মোহাম্মদ আলী ও শাহ আজম। এদের মধ্যে নূরুল কবিরের আল আরাফা ইসলামী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট (হিসাব) জব্দ করা হয়েছে। আব্দুল শুকুরের ৮টি ব্যাংক হিসাবে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেলেও সেখানে টাকা জমা না থাকায় তা জব্দ করা হয়নি। বাকি সবারই একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেনের হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
এ মামলাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর তালিকায় থাকা অন্যদের সম্পর্কে অনুসন্ধান শেষে পর্যায়ক্রমে মামলা করা হবে বলে জানিয়েছেন সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (সদ্য বদলি হয়েছেন) মোস্তফা কামাল।
২০২০ সালের মার্চে উল্লিখিত ১২ জনের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় করা মামলাগুলো তদন্ত করছে সিআইডি। এক বছর ধরে মামলার তদন্তকালে আসামিদের স্থাবর-অস্থাবর অনেক সম্পদের খতিয়ান এখন তদন্ত সংস্থার হাতে। এ মামলাগুলোর তদন্ত শেষ হলে তালিকায় থাকা অন্যদের বিরুদ্ধেও পর্যায়ক্রমে মামলা করা হবে বলেও জানা গেছে।
সিআইডি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফের নাজিরপাড়া এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ আলম স্থানীয় একটি সরকারি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু শিক্ষকতার সীমিত আয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি। রাতারাতি ধনী হওয়ার নেশা পেয়ে বসে তাকে। তাই শিক্ষকতা ছেড়ে ২০১১ সালে ইয়াবা কারবারে নামেন। টেকনাফের কুখ্যাত ইয়াবা ডন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মাত্র তিন বছরেই সৈয়দ আলম বনে যান কোটিপতি।
টেকনাফের ইয়াবা কারবারের আরেক গডফাদার নুরুল হক ওরফে ভুট্টোর সম্পদ ও অর্থবিত্ত কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। আদালতের নির্দেশে ভুট্টো ও তার পরিবারের সদস্যদের বিপুল ধন-সম্পদ জব্দ করেছে পুলিশ। ২০১৯ সালের মার্চে ভুট্টোর ভাই নুর মোহাম্মদ মারা গেছেন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে। ভুট্টোর পরিবারের নয় সদস্যের নাম আছে ইয়াবা কারবারিদের তালিকায়।
নাজিরপাড়ায় ভুট্টোর প্রাসাদোপম দুটি বাড়ি পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। এরমধ্যে একটি বাড়ির মূল ফটক তৈরিতেই খরচ হয়েছে অন্তত ২০ লাখ টাকা। আরেক মাদক ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমানের বাড়িটিও ছিল নজরকাড়া। বাড়িতে বাইরের লোকজনের যাতায়াত ছিল নিষিদ্ধ। তার বাড়িটি ভেঙে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ এলাকায় সৈয়দ আলম ও নূরুল হক ভুট্টোর মতো অসংখ্য মানুষ ইয়াবা কারবার করে অঢেল ধন-সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন।
ইয়াবা কারবারিদের ধনসম্পদ নিয়ে দীর্ঘদিন অনুসন্ধান চালিয়েছেন সিআইডির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজিম আল আজাদ। বর্তমানে তিনি মালিতে জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত। সম্প্রতি সেখান থেকে মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলছেন, টেকনাফে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া অনেকেই মাত্র ২-৩ বছর আগেও ছিলেন দিনমজুর। ইয়াবা গডফাদার নুরুল হক ওরফে ভুট্টো ও তার ভাই নূর মোহাম্মদ মাত্র ৩-৪ বছর আগেও এলাকায় দিনমজুরি করতেন। রিকশা চালাতেন। তাদের বাবা এজাহার মিয়া ছিলেন মুদি দোকানি। কিন্তু এখন তাদের ব্যাংক হিসাবে টাকার ছড়াছড়ি। জায়গা, জমি, বাড়ি, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই।
পুলিশের তালিকা ধরে দেড় মাস আগে সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সমুদ্রতটে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম উপজেলা আনোয়ারা। এ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে যারা মৎস্য শিকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসা-বাণিজ্য করে সাদামাটা জীবন কাটাতেন তাদের অনেকেই এখন ‘ইয়াবা সম্রাট।’ এখানকার অর্ধশত ট্রলার মালিক মাছ ব্যবসার আড়ালে জড়িয়ে পড়েছেন ইয়াবা কারবারে। অল্প সময়ে বিত্তশালী হতে গিয়ে তাদের নাম এখন জায়গা পেয়েছে পুলিশের মাদক কারবারির তালিকায়। আনোয়ারার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মেঠোপথ ঘেঁষেই এদের অনেকেই তৈরি করেছেন সুরম্য অট্টালিকা। গ্রাম ছাড়িয়ে শহরেও রয়েছে তাদের বাড়ি-গাড়ি।
পুলিশের তালিকা ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আনোয়ারার সোলেমান ওরফে মানু, জলিল আহমেদ, দক্ষিণ পরুয়াপাড়া গ্রামের হাসান মাঝি, ছাবের আহমেদ, দোভাষীর জসিম, আজু মিয়া, চুন্নুপাড়া গ্রামের কালামনু, কালাইয়া, সাদ্দাম হোসেন ওরফে জেলে সাদ্দাম, মহোরম আলী, ভুইশ্যা, চুন্নুপাড়ার মোকারম, নুরুল, আইয়ুবসহ আরও ১০-১২ জন ইয়াবার বড় কারবারি। তাদের কারবারের জের ধরেই বদলে গেছে গোটা এলাকা। এরা সবাই বিপুল ধন-সম্পদের মালিক বনে গেছেন। ইদানীং এক শ্রেণির অসৎ পুলিশ কর্মকর্তাদেরও ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়ার তথ্য মিলেছে।
মাদক কারবারিদের তালিকার কথা স্বীকার করে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এখন নতুন নামও তালিকায় সংযুক্ত করা হচ্ছে। তালিকাভুক্ত অনেকেই কারাগারে আছে। আবার অনেকেই জামিনে বেরিয়ে পুনরায় ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। তাদেরও কাউকে কাউকে ফের গ্রেফতার করা হয়েছে । যারা বড় কারবারি তারা এলাকায় থাকে না। প্রতিদিনই নতুন নতুন মাদক কারবারি তৈরি হচ্ছে, ধরাও পড়ছে। শুধু বিক্রেতা নয়, মাদক কারবারে অর্থ লগ্নিকারী, পৃষ্ঠপোষক, সংরক্ষক, বহনকারী, খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান। ফেব্রুয়ারিতে সবচেয়ে বড় চালান কক্সবাজার জেলা পুলিশ আটক করে। গত ৭ মাসে তারা ৩২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করেছে। যাতে জড়িতদের আদালতে সাজা হয় সে ব্যাপারে কঠোরভাবে কাজ করা হচ্ছে। কতিপয় পুলিশ সদস্যদের কারবারে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে জিরো টলারেন্স (শূন্য সহিষ্ণুতা) দেখানো হচ্ছে। জড়িতদের শনাক্ত করে ফৌজদারি আইনে মামলা করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা যুগান্তরকে বলেন, দেশে ব্যবহৃত মাদক দেশের বাইরে থেকে আসে। সীমান্ত পথে দেশে মাদকের প্রবেশ ঠেকানো পুলিশের আওতাধীন নয়। মাদক দেশে প্রবেশের পর মুহূর্তেই হাজার হাতে ছড়িয়ে পড়লে পুলিশের পক্ষে বিস্তার ও ব্যবহার রোধ সহজ হয় না।
শূন্য থেকে কোটিপতি : ডিবি পুলিশ জানায়, সম্প্রতি ১০ হাজার ইয়াবাসহ চট্টগ্রামের ২ নম্বর গেট এলাকায় ধরা পড়ে নুরুল হুদা নামের এক যুবক। সাত বছর আগেও তিনি ছিলেন বাস হেলপার। আর বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত এলাকার যে ফ্ল্যাটে তার পরিবার থাকে, সেটির ভাড়াই ৩৫ হাজার টাকা। গাড়িও আছে দুটি। জমি কিনেছেন কক্সবাজার শহরে। কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে চট্টগ্রামে।
গত বছরের ৪ মে হালিশহরের শ্যামলী হাউজিং সোসাইটির একটি ফ্ল্যাটে ধরা পড়ে ইয়াবার বড় চালান। ১৩ লাখ ইয়াবাসহ আশরাফ ও হাসান নামে দুই সহোদরকে গ্রেফতার করা হয়। আশরাফ ছিলেন সৌদি আরব প্রবাসী। তাদের বাড়ি বান্দরবানের পার্বত্য জেলায়। আশরাফ প্রবাস জীবনে তেমন উন্নতি করতে পারেননি। তবে দেশে এসে মাত্র দুই বছর ইয়াবা কারবার করেই বনে গেছেন বিত্তশালী।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, এক দশক আগেও রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ফুটপাতে দোকান করে সংসার চালাতেন ইশতিয়াক আহমেদ। বিহারি ক্যাম্পের অবাঙালি বাসিন্দা ইশতিয়াকের এখন মোহাম্মদপুর, উত্তরা, আমিনবাজার ও আশুলিয়ায় ১১টি বাড়ি। ঘুরে বেড়ান দামি গাড়িতে। সাভার ও আশুলিয়ায় তিনি পরিচিত ‘দানবীর’ কামরুল নামে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে গ্রেফতার হওয়ার পরই জানা গেছে, ‘দানবীর’ কামরুল ওরফে ইশতিয়াক ইয়াবা কারবারি। অবৈধ এ কারবার করেই তিনি বনে গেছেন বিত্তশালী।
দীর্ঘদিন ধরে মাদকবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. মুহিত কামাল। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মাদক মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ও ক্ষেত্র বিশেষে বিচারহীনতার কারণে বড় মাদক কারবারিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। সাক্ষী পাওয়া যায় না। আলামত নষ্ট করে ফেলেন। মাদক কারবারিদের উদ্ভাবনী কৌশলের কাছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুলিয়ে উঠতে পারে না। এক্ষেত্রে পুলিশের একার পক্ষে মাদক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন দরকার। একই সঙ্গে ইয়াবা কারবারিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তারা যেন জামিন না পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে সর্বাগ্রে সচেতন করতে হবে যুব সমাজকে। কেন তারা মাদক নেবে। চাহিদা যখন কমবে কারবারিরাও তখন আগ্রহ হারাবে।
দাদন দিয়ে বিত্তশালী অনেকেই : সিআইডির তথ্যমতে, অনেকে সরাসরি ইয়াবা কারবার না করে অর্থ লগ্নি করছেন। মাসে দ্বিগুণ লাভে ইয়াবা কারবারিদের দাদন দিয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন তারা। নগদ টাকার জোগান পেয়ে খুদে কারবারিদের অনেকেই এখন ডিলার। মাদকে ‘পুঁজি বিনিয়োগ’র এ কারবার দেশে প্রচলিত এনজিওগুলোর চক্রবৃদ্ধি সুদ, মালটিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানিগুলোর স্বপ্ন দেখানো ধাপ্পাবাজিকেও ছাপিয়ে গেছে। পুঁজির দ্বিগুণ লাভ করতে গিয়ে অনেকেই আবার সর্বস্ব হারাচ্ছেন।
দেশের প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ইয়াবা কারবারি ও লেনদেনের তথ্যানুসন্ধানে নেমে ‘দাদন ব্যবসা’র চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। দেশের সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবারে কমবেশি পুঁজি বিনিয়োগের নজির থাকলেও খোদ রাজধানীতে ‘মাদকে দাদন ব্যবসা’র নতুন তথ্য পেয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, পুঁজির সহজলভ্যতাও মাদক ব্যবসা বিস্তারের একটি বড় কারণ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা দাদন বাণিজ্যে জড়িতদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ জানিয়ে শিগগিরই তালিকাটি সরকারের উপর মহলে পাঠানো হবে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন. কক্সবাজারের রামুর বাসিন্দা জনৈক শওকত হোসাইন। তিনি জায়গা-জমি ও বসতঘর বিক্রি করে পাঁচ লাখ ত্রিশ হাজার টাকা দুজন ইয়াবা কারবারিকে দাদন দেন। মাত্র দেড় বছরেই শওকত হয়েছেন কোটিপতি। তবে তদন্তে শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ব্যাংকে লেনদেন : সিআইডির মানি লন্ডারিং ইউনিটের এক কর্মকর্তা আলাপকালে জানান, ইয়াবা কারবারিরা প্রতিদিন আর্থিক ও মোবাইল ব্যাংকিং চ্যানেলে যে পরিমাণ লেনদেন করে তা ভয়াবহ। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ইয়াবা কারবারি ও গডফাদাররা মিলেমিশে একটি স্বতন্ত্র ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করারও ক্ষমতা রাখেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সাধারণ ব্যবসার মতোই ইয়াবা কারবারের টাকা জমা পড়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে।
দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা থেকে টেকনাফের স্থানীয় শাখায় কোটি কোটি টাকা জমা হচ্ছে। ছয়টি ব্যাংকের কক্সবাজার ও টেকনাফ শাখায় কয়েকজন ইয়াবা গডফাদারের ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি। একই সঙ্গে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ইয়াবা কারবারের টাকা লেনদেন হচ্ছে প্রতিদিনই।
এ ব্যাপারে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (সদ্য বদলি হওয়া) মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন- মানি লন্ডারিংয়ের অনেক মামলা আমরা তদন্ত করছি। আদালতের নির্দেশে অনেকের মালামাল ক্রোকও করা হয়েছে। বিভিন্ন থানায় নিয়মিত মামলার তদন্তকালে অবৈধ কারবারের মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট থানা থেকে আমাদের কাছে মানি লল্ডারিং মামলা করার প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাব পাওয়ার পর তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পেলে মানি লন্ডারিং মামলা করা হয়।
Leave a Reply