প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে প্যারিস চুক্তির কঠোর বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। আর এ জন্য দূষণ থেকে বিশ্বকে বাঁচানোর মূল দায়িত্ব ধনী দেশগুলোকেই নিতে হবে। তবে কার্বন নিঃসরণ বন্ধে সব দেশকেই ভূমিকা নিতে হবে। কারণ, এক জায়গায় কার্বন নিঃসরণ হলে তা সারাবিশ্বেই ছড়িয়ে যায়।
মঙ্গলবার রাতে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন আয়োজিত ভার্চুয়াল ক্লাইমেট সামিটে এক ভিডিও বার্তায় তিনি এ কথা বলেন। খবর বাসসের
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো নির্দিষ্ট সীমানা নেই। একটি দেশ কার্বন নিঃসরণ করলে প্রতিটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে জন্য প্রতিটি দেশকেই দূষণ বন্ধে ভূমিকা রাখতে হবে। তবে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমাতে ধনী দেশগুলো, বিশেষ করে জি২০ জোটভুক্ত দেশগুলোর মূল ভূমিকা পালন করা উচিত।’
প্যারিস চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসাকে ‘সুখবর’ হিসেবে বর্ণনা করে এ সিদ্ধান্তের পাশাপাশি গত সপ্তাহে ‘লিডার্স সামিট’ আয়োজনের জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশংসা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজন ও প্রশমনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্যারিস চুক্তিতে প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি ডলার তহবিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্যারিস চুক্তির কঠোর বাস্তবায়ন বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ ও তার ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধ করার একমাত্র উপায়। ধরিত্রীকে বাঁচাতে ব্যবস্থা নেওয়ার আজই সময়, কাল নয়।
বৈশ্বিক উষ্ণতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে বিপর্যয় এড়ানোর জন্য আর বেশি সময় হাতে নেই বলে সতর্ক করে আসছেন বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরাও। তারা বলছেন, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়তে থাকায় সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে; ঝড়, বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ পাচ্ছে নতুন মাত্রা।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এভাবে বাড়তে থাকলে এই শতকের মাঝামাঝি সময়েই পৃথিবীর নিচু এলাকাগুলোর শতকোটি মানুষকে বাস্তুহারা হতে হবে। ভয়ংকর সেই পরিণতি থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে চুক্তিবদ্ধ হন বিশ্বনেতারা।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না হতে পারে, সে জন্য নিঃসরণের মাত্রা সম্মিলিতভাবে কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করা হয় সেই চুক্তিতে। এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৯টি দেশ ওই চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করেছে।
বিশ্বে যে দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, বাংলাদেশ রয়েছে সে তালিকার একেবারে সামনের সারিতে। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের প্রধান।
ভাষণের শুরুতে আমন্ত্রণের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে করোনাভাইরাস মহামারি থেকে মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন শেখ হাসিনা।
ধারণ করা ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, কভিড-১৯-এর পর সম্ভবত এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন। প্রতিটি দেশের জন্য, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু সংবেদনশীল দেশগুলোর জন্য এটা বিশাল হুমকি।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধিকে ‘সমস্ত দুর্বিপাক’ এবং মানুষের জীবনধারণের জন্য ‘সবচেয়ে বড় চাপের কারণ’ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে আমরা বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে যেন না বাড়ে, সে ব্যাপারে একমত হয়েছি। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাসের নিঃসরণ রোধে উল্লেখযোগ্য কিছু করা যায়নি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো প্রতিনিয়ত বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাতসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমার দেশের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গত বছর বাংলাদেশ ভারি বর্ষণ মোকাবিলা করেছে, সে সময় দেশের এক-তৃতীয়াংশ নিমজ্জিত হয়েছিল। সুপার সাইক্লোন আম্পানসহ বেশ কয়েকটি সাইক্লোন গত বছর আমার দেশের ওপর আঘাত হেনেছে। এসব ঘটনা ঘটেছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বড় দূষণকারী দেশ নয়। প্রকৃতপক্ষে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) কোনো সদস্য দেশই উল্লেখযোগ্য কার্বন নিঃসরণ করে না। তবু আমরাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। প্রতিবছর আমার দেশের জিডিপির ২ শতাংশ যায় জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায়।
তিনি বলেন, নিচের দিকের ১০০টি দেশ বৈশ্বিক নির্গমনের মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশের জন্য দায়ী, যেখানে জি২০ দেশগুলো ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী। সিভিএফ দেশগুলো জলবায়ু অভিযোজনে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
প্রথম নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল গঠনের পর ৮০০টির বেশি প্রশমন ও অভিযোজন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিজস্ব সম্পদ থেকে চার কোটি ১৫ লাখ ডলারের বেশি ব্যয় করেছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংসদ ২০১৯ সালে জলবায়ু সংবেদনশীলতার বর্তমান অবস্থাকে ধরিত্রীর জন্য ‘জরুরি অবস্থা’ হিসেবে ঘোষণা করে একটি প্রস্তাবও গ্রহণ করেছে।
Leave a Reply