চার বছরের ব্যবধানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর কেন্দ্রিক হওয়া তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেছে। জেলা পরিষদ, সদর উপজেলা পরিষদ ও বিজয়নগর উপজেলা পরিষদ (সদর-বিজয়নগর সংসদীয় আসন) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদটি হাতছাড়া হয় আওয়ামী লীগের। যে কারণে পৌর নির্বাচনকে সামনে রেখে আলোচনায় চলে এসেছে ওই তিনটি নির্বাচন। ওই তিন নির্বাচনের পথ ধরে পৌরসভার ফল কী হয় এবং আওয়ামী লীগ এসব নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে ফলাফল নিজের ঘরে আনতে পারবে এ নিয়ে চলছে যত আলোচনা। এসব নির্বাচন অবশ্য আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও তার নেতাকর্মীদেরকে আশা জোগাচ্ছে।
তবে সার্বিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে অনেকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্তই মনে হচ্ছে। পরিস্থিতি সামলাতে ইতিমধ্যেই ‘বিদ্র্রোহী’ প্রার্থী মো. মাহমুদুল হক ভূঁইয়াসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগি সংগঠনের ২০ নেতাকে বহিস্কার করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে বিদ্রোহী প্রার্থীর নিজ এলাকা ভাদুঘরে আওয়ামী লীগ প্রচারণায় গিয়ে সেখানকার তেমন লোকজন পায়নি। ওই এলাকায় একপ্রকার অঘোষিত ‘হরতাল’ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার দক্ষিণ মৌড়াইলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ক্যাম্পে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা দলটির ‘সাজানো’ দাবি করেছেন বিদ্রোহী প্রার্থী। একই সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নেতাকর্মীদের হুমকি ও প্রশাসনের বাঁধার কারণে অনুমতি নিয়ে পথসভা করতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর হওয়া জেলা পরিষদ নির্বাচনে ৬৫০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. শফিকুল আলম। ওই নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সৈয়দ এ কে এম এমদাদুল বারী (৫৯৯ ভোট)। ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল হওয়া সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলমের ভরাডুবি হয়। জয়ী বিদ্রোহী প্রার্থী ফিরোজুর রহমান ওলিও’র ৬৮ হাজার ২৩৩ ভোটের বিপরীতে জাহাঙ্গীর আলম পান ২৬ হাজার ৯০৭ ভোট। ওই নির্বাচনে প্রশাসন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে বলে অভিযোগ ওঠে। দুই মাস পর ১৯ জুন হওয়া বিজয়নগর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নাছিমা মুকাই আলী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, সত্যি কথা বলতে দলটি এখন বেকায়দায়। বিদ্রোহী প্রার্থীকে দমাতে না পেরে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ নিজের ভোট নিজে দেয়ার সুযোগ পেলে বিগত তিনটি নির্বাচনের মতো ফলাফল হয়ে যায় কিনা সেটা দেখার বিষয়। তবে শেষ পর্যন্ত ভোটাররা উন্নয়নের কথা চিন্তা করে, এলাকার শান্তিশৃঙ্খলার কথা চিন্তা করে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকেই বেছে নেবেন বলে বিশ্বাস করি। ভোটারদের কাছে বর্তমান মেয়রের ব্যক্তিগত ইমেজ ও অন্য প্রার্থীদের অবস্থানের কথা তুলে ধরা হচ্ছে।
আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার নির্বাচন। মেয়র পদে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়াই করছেন বর্তমান মেয়র নায়ার কবির। আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হিসেবে মোবাইল ফোন প্রতীক নিয়ে লড়ছেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. মাহমুদুল হক ভূঁইয়া।
বিএনপি’র প্রার্থী হলেন, দলটির জেলা কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. জহিরুল হক খোকন। মোট ছয়জন প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মূলত উল্লেখিত তিনজনের মধ্যে লড়াই হবে বলে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে।
একাধিক সূত্র জানা গেছে, বিদ্রোহী প্রার্থী মাহমুদুল হক ভূঁইয়া পারিবারিক সূত্রে পৌর এলাকার ভাদুঘরের ও বর্তমান অবস্থান সূত্রে কাজীপাড়ার বাসিন্দা হওয়ায় ওই এলাকার ভোট নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আওয়ামী লীগ। মূলত দুটি এলাকাই আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। কিন্তু এলাকার বাসিন্দা হিসেবে এসব ভোটের বেশিরভাগই পড়তে পারে মাহমুদের পক্ষে। এছাড়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হিসেবে পুরো পৌর এলাকাজুড়েই মাহমুদুল হকের নিজস্ব কিছু বলয় রয়েছে। যে কারণে বিদ্রোহী প্রার্থীর গ্যাঁড়াকলে পড়ে বিএনপি প্রার্থী পার পেয়ে যান কিনা সেই দুশ্চিন্তাতেই আছে আওয়ামী লীগ।
গত শুক্রবার সকালে ভাদুঘর এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় যান আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী নায়ার কবির। ওই সময়ে এলাকার সব দোকানপাট বন্ধ ছিল ও বাড়ি-ঘরে মানুষও খুব একটা ছিলেন না। অন্য এলাকা থেকে যাওয়া লোকজনকে নিয়ে সেখানে একটি সংক্ষিপ্ত পথসভা করেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী।
এদিকে বর্তমান মেয়রের আমলে খুব একটা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড না হওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রচারণায় এ বিষয়ে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছে না দলটির নেতাকর্মীরা। এ অবস্থায় বর্তমান মেয়রের ব্যক্তিগত ইমেজকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমান মেয়রের আমলে পৌরসভার উন্নয়ন কাজে টেন্ডারবাজি, ভূমি দস্যুদের তৎপরতা একেবারে কমে আসা, স্কুলের খেলার মাঠ থেকে সরিয়ে মূল পৌর এলাকার বাইরে গরুর বাজার নিয়ে পৌরসভার সৌন্দর্য্য রক্ষা ও আয় বাড়ানো, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচলে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসা, টাউন খাল উদ্ধারে কিছু ভূমিকা নেয়াসহ উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্যোগের কথা প্রচার করা হচ্ছে। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি হয়েও দলীয় রাজনীতিতে কোনো ধরণের বলয় সৃষ্টি না করা কিংবা দলীয় শৃঙ্খলা মেনে কাজ করার বিষয়টিও ভোটারদের মাঝে তুলে ধরা হচ্ছে। পৌর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রাখতে মেয়রের ভূমিকার কথাও ভোটারদেরকে বলা হচ্ছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আল-মামুন সরকার সাংবাদিকদের সঙ্গে এক আলোচনায় বলেন, প্রত্যেক পৌরসভাতেই একবার পাঁচ বছর ব্যাপক উন্নয়ন হলে পরের পাঁচ বছর হয় না। যে কারণে বর্তমান মেয়রের আমলে হয়তো বড় ধরনের উন্নয়ন দৃশ্যমান নয়। তবে একেবারে উন্নয়ন হয়নি সেটা বলা যাবে না। উন্নয়নের জন্য উনি সাধ্যমতো চেষ্টা করে গেছেন। উনি মেয়র থাকাকালে পৌর এলাকার মানুষ অনেক শান্তিতে ছিল। দলীয় কিংবা ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে তিনি কিছু করেছেন সেটা কেউ বলতে পারবেন না। এবার নির্বাচিত হলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই তিনি অনেক উন্নয়ন কাজ করতে পারবেন।
Leave a Reply