“আইজ থাইক্যা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। আমি তহন ম্যালা চুডু ছিলাম। আমরার ঘরে ভাতের খুব অভাব ছিলো। কিনোদিনই তিন বেলা পেট ভইরা ভাত খাইতে পারি নাই। তহন হঠাৎ একদিন কয়েকটা ঘুড্ডি বানায়া বাজারে চললাম। ঘুড্ডি বেইচ্যা যে টেহা হাইছি (পেয়েছি) হেই টেহা দিয়াই সদাইপাতি ( বাজার করে) কিন্যা মনের সুখে বাড়িতে আয়া পরছি। হেইবালা থাইক্যা আইজ পর্যন্ত আমি ঘুড্ডি বানানিতেই আছি।”
কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার সহনাটী ইউনিয়নের সহনাটী গ্রামের কান্দাপাড়া অধিবাসী মরহুম নবী নেওয়াজের পুত্র মোঃ আবুল কালাম আজাদ (৬৫)। তবে এলাকায় তাকে এই নামে খুব কম লোকেই চেনে। তার ব্যতিক্রমধর্মী একটা নাম রয়েছে। আর সেটা হলো আনাম্মিয়া। ঘুড়ি বিক্রেতা আনাম্মিয়াকে এখন গৌরীপুর উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি উপজেলায় একনামে জানতো । ঘুড়ি বিক্রি করে তিনি সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছিলেন। আজ থেকে ৩০ বছর আগে পিতাকে হারিয়েছিলেন এই ঘুড়ি নির্মাতা। পিতৃ প্রদত্ত বিশ শতাংশ জমির উপর নির্ভর ছিলো তার সংসার। সাংসারিক জীবনে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। ছেলে মেয়ে দু’জনকেই বিয়ে দিয়েছেন এই ঘুড়ি বিক্রি করে। ক্রয় করেছিলেন প্রায় ৩০ শতাংশ জমি এবং বসবাস করার জন্য ভাঙা ও পুরাতন জীর্ণ শীর্ণ ঘরের জায়গায় তুলেছেন একটি আধা পাকা বাড়ি। একমাত্র ছেলে তেমন লেখাপড়া না করায় বাড়িতেই তাকে একটি দোকান দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিলেন ব্যবসার কাজে। বাড়ির সবাইকে নিয়ে ঘুড়ি তৈরি করে বদলে দিয়েছেন ভাগ্যের চাকা। অথচ একসময় তার জীবন ছিলো খুবই কষ্টের। দিনগুলো যাচ্ছিলো প্রায় অনাহারে অর্ধাহারে। কিন্তু তিনি আজ ঘুড়ি বিক্রি করে হয়েছিলেন লাখপতি।
এই ঘুড়ি নির্মাতা শুধু ঘুড়ি তৈরিতেই সিদ্ধহস্ত নন তিনি ঘুড়ি উড়াতেও একজন দক্ষ খেলোয়াড় ছিলেন। অত্র এলাকার যত ঘুড়ি প্রতিযোগিতা হতো সেখানে তিনি ঘুড়ি উড়িয়ে প্রথম স্থান দখল করবেন এটাই স্বাভাবিক। গৌরীপুর উপজেলার সাবেক স্বাস্থ্যপ্রতিমন্ত্রী প্রয়াত ডাঃ ক্যাপ্টেন (অবঃ) মজিবুর রহমান ফকিরের উপস্থিতিতে গৌরীপুর খেলারমাঠে ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান দখল করে চমকে দিলেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)সহ উপস্থিত আমজনতাকে। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন সতেরো ইঞ্চি একটি রঙিন টেলিভিশন।সেই সহনাটীর আবুল কালাম আজাদ অরফে আনাম্মিয়ার জীবন, জীবনের গল্পের সমাপ্তি হল আজ।
হঠাৎ করেই চলে গেলেন মহাকলের পথে। ইন্নালি…….।
হয়তো প্রতিদিনই মেঘমুক্ত আকাশে রং-বেরঙের ছোট বড় ঘুড়ি উড়তে দেখা যাবে। কখনওবা রাতের অন্ধকারেও কিছু সৌখিন মানুষ তাদের ঘুড়িতে লাইটিং ব্যবহার করে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে সৌখিনতার পরিচয় দিবেন। আর এসব ঘুড়ির একমাত্র স্রষ্টা সহনাটীর আবুল কালাম আজাদ অরফে আনাম্মিয়া কে আর পাওয়া যাবেনা আমাদের মাঝে,শান্তির শ্বেত পাখি হয়ে উড়ে বেড়াবেন ঘুুুড়ি প্রেমিক সকল মানুষের মনের আকাশে।
Leave a Reply