দেশের মাদক কারবারের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্ট এখন নারায়ণগঞ্জ জেলা। ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগস্থল কাঁচপুর এলাকা হল এ মাদকের অন্যতম বর্ডার।
এ দুই মহাসড়কে চলাচলকারী ৩৬টি রুটের যানবাহনে করে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জে মাদকের বিপুল পরিমাণ চালান প্রবেশ করছে।
এর মধ্যে ইয়াবা ও ফেনসিডিলের সবচেয়ে বড় চালানগুলো আসছে মিয়ানমার ও ভারতীয় সীমান্ত পার হয়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা জেলা হয়ে। তবে ফেনসিডিলের চেয়ে এখন সবচেয়ে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে মরণ নেশা ইয়াবা। পুরো জেলায় এমন কোনো পাড়া-মহল্লা নেই যেখানে ইয়াবার কারবার না হচ্ছে।
জানা গেছে, শুধুমাত্র রূপগঞ্জের চনপাড়া বস্তি এলাকাতেই প্রতিদিন ইয়াবার চাহিদা রয়েছে প্রায় ২০ হাজার পিসের মতো। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ শহর এখন যেন ইয়াবার শহরে পরিণত হয়েছে। শহর ও শহরতলীর যে কোনো পাড়া-মহল্লাতেই হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা।
শুধু নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুর, নগর খানপুর, তল্লা, জামতলা, দেওভোগ এলাকাতেই প্রতিদিন গড়ে কয়েক হাজার পিস ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে বলে বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে। মাদকের এই নীল দংশনে ধ্বংস হচ্ছে জেলার কিশোর ও যুব সমাজসহ অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা।
তবে র্যাব-১১ এর অভিযানে নিয়মিত মাদক উদ্ধারের ঘটনা দেখা গেলেও জেলা পুলিশের ৭টি থানা ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মাদক উদ্ধারে তেমন কোনো বড় সাফল্য দেখা যাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন থানা এলাকায় পুলিশের সাথে মাদক ব্যবসায়ীদের সখ্যতার কারণেই মাদকের এ ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, ইদানীং ইয়াবা ব্যবসায় কিশোর বয়সের ছেলে ও নারীরা জড়িয়ে পড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। ফলে সমাজে ধীরে ধীরে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
তারা বলছেন, যে কিশোর গ্যাংয়ের উদ্ভব হয়েছে প্রতিটি এলাকায়- তার নেপথ্যের প্রধান কারণই হল মাদকের সহজলভ্যতা। চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক শেল্টারে কিশোরদের দিয়ে মাদক ব্যবসা করাচ্ছে বলেই এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে কিশোর গ্যাংয়ের লড়াই হচ্ছে, খুনের মতো ঘটনা ঘটছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করা এসব মাদকদ্রব্য বিভিন্ন কৌশলে ট্রাক অথবা বাসযোগে পৌঁছে যাচ্ছে নিজ গন্তব্যে। এছাড়াও ঢাকার আমিনবাজার, গেণ্ডারিয়া, কমলাপুর, শ্যামপুর ও আশপাশের এলাকা থেকেও মাদকের ছোট-বড় চালান প্রবেশ করছে নারায়ণগঞ্জে।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, সিদ্ধিরগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় বিভিন্ন পরিবহনের পার্সেল সার্ভিসের নামে নারীদের প্রসাধনী পণ্যের ভেতর আসছে হাজার হাজার ইয়াবা।
জানা গেছে, শুধু নারায়ণগঞ্জ শহর ও আশপাশের এলাকাগুলোতেই প্রায় দেড় শতাধিক মাদকস্পট রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জ, তল্লা, ব্যাংক কলোনি, মাছুয়াপাড়া, আমলাপাড়া, নন্দীপাড়া, জামতলা, ধোপাপট্টি, পালপাড়া, ৫নং ঘাট, বৌবাজার, বাবুরাইল, নয়াপাড়া, জলারপাড়া, জিমখানা, নতুন জিমখানা, সূতারপাড়া, নিতাইগঞ্জ, নয়ামাটি, বালুর মাঠ, শহরের শহীদ মিনার এলাকা, ফতুল্লার কুতুবাইল, রেললাইন, কাঠেরপুল, পৌষার পুকুরপাড়, দেওভোগ, শিবু মার্কেট, নতুন স্টেডিয়াম এলাকা, বাড়ৈভোগ, মাসদাইর, ইসদাইর, সস্তাপুর, পুলিশ লাইন, গাবতলীসহ প্রায় প্রত্যেক মহল্লায় এখন হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যাচ্ছে।
এছাড়াও জেলার বন্দর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নেও হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, ফেনসিডিল। সূত্র জানায়, বন্দরের সিটি কর্পোরেশনের শুধু ২২নং ওয়ার্ডের খাদিমপাড়া, লতিফ হাজীর মোড়, একরামপুর কলেজ মাঠ, উত্তরপাড়া, বাগবাড়ী, হাসপাতাল মোড় এলাকায় রয়েছে দেড় ডজন ইয়াবার স্পট।
এসব এলাকার পাশাপাশি ফতুল্লার বিশাল বিসিক এলাকাতেও মাদকের ব্যবসা চলছে। এদিকে গত কয়েক দিনে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রগুলো জমজমাট ব্যবসা করছে। এসব কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশই যুবক এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক জানান, মূলত একটি মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমরা নিরাময় কেন্দ্র খুলেছিলাম। কিন্তু মাদকের পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে, কেন্দ্রগুলো এখন ব্যবসায়িক চিন্তাধারায় গড়ে উঠছে।
স্থানীয় অধিবাসীদের অভিমত, মাদকের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব শুধু পুলিশের নয়। রাজনৈতিক নেতাদের এবং সব দলের এই প্রশ্নে এক হতে হবে। কারণ যারা মাদক ব্যবসা করে তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের শেল্টার ব্যবহার করে থাকে।
এ ব্যাপারে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মহসিন মিয়া জানান, মাদকসেবীর চেয়ে মাদক ব্যবসায়ী শতগুণ বেশি অপরাধী। আমিসহ অনেক আইনজীবীই চিহ্নিত কোনো মাদক ব্যবসায়ীর পক্ষে আদালতে দাঁড়াই না।
তিনি বলেন, মাদক নির্মূল করতে হলে আইনজীবীরা এমন ভূমিকা পালন করলে মাদক ব্যবসার আগে তারা শতবার চিন্তা করবে।
জেলায় মাদকের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার হিসেবে পরিচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমান যুগান্তরকে জানান, মাদকের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার নয়। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এজন্য রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। কারণ দেশের ভবিষ্যৎ যুব সমাজকে ধ্বংস করছে এই মাদক। মাদক ব্যবসায়ীর কোনো দল নেই, কোনো সমাজ নেই।
জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম পিপিএম বলেন, আমি যোগদানের পরপরই মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছি। গত কয়েক মাসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিনই বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু সামাজিকভাবে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে না তুলতে পারলে কোনো জেলাতেই মাদকের করাল গ্রাসকে রুখে দেয়া সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে যদি মাদক গ্রহণ বা মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্যতা বিন্দু পরিমাণ প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Leave a Reply