ইয়াসরিব তখনো মদিনা হয়নি। এটা ছিল ইহুদিদের আদি নিবাস। নবীজি (সা.) হিজরত করে সেখানে এলেন। সত্যের আলোয় আলোকিত করে দিলেন ইয়াসরিববাসীর হৃদয়জগৎ। তার উত্তম চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আসতে লাগল। পৃথিবীর মানচিত্রে স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ এক ভূস্বর্গের আবিষ্কার হলো। ‘মদিনাতুর রাসুল’ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর শহর।
সেই শহরের এক ছোট বালক। সবেই শুনেছে নবাগত নবী মুহাম্মদের নাম। তিনি নাকি ছোটদের খুব স্নেহ করেন। আদর করে কাছে টেনে নেন। পরম ভালোবাসায় হাত বুলিয়ে দেন তাদের মাথায়। তাঁকে খুব দেখতে ইচ্ছা হলো বালকের।
দেখা হলো। কথাও হলো। আরো কী হলো?
মনের অজান্তেই দুজনের মধ্যে এক অকৃত্রিম ভালোবাসা সৃষ্টি হলো। ভালো লাগে নবীজির পাশে পাশে থাকতে। নবীজির মুখের দিকে চেয়ে তাঁর কথা শুনতে। তাঁর সাহচর্যলাভে পূর্ণ হতে। তাঁর খেদমত করে ধন্য হতে।
কিন্তু বাধা একটাই। অনেক বড় বাধা। তার মধ্যে আর নবীজির মধ্যে ধর্মের এক বিশাল প্রাচীর। সে তো ইহুদি। তার মা-বাবাও ইহুদি। তাহলে…?
বালক তার বাবার সঙ্গে এ নিয়ে অনেক কথাই বলেছে। বলেছে নবীজি (সা.)-এর সুন্দর চরিত্রের কথা। তাঁর স্নেহ ও প্রীতির কথা। কিন্তু বাবা ইসলামের কথা মানতেই নারাজ।
এত দিনে নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে তার সম্পর্কেরও বেশ উন্নতি হয়েছে। এখন তো সে নিয়মিত নবীজির খাদেম। তিনি অজু করতে চাইলে পানি নিয়ে আসে এই বালক। তিনি মসজিদে প্রবেশের সময় জুতা তুলে নেওয়া, বের হওয়ার সময় জুতা নিয়ে হাজির হওয়া বালকের প্রতিদিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ কিছুদিন হলো বালকের দেখা নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাওয়া গেল না তাকে। প্রিয় নবী খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
নবীজি মসজিদ-ই-নববীতে বসে আছেন। একজন লোক হন্তদন্ত হয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা নিয়ে এসেছে।
হে আল্লাহর রাসুল! আপনার সেই ইহুদি খাদেমের সন্ধান পেয়েছি। বেশ কিছুদিন ধরে সে খুব অসুস্থ ছিল। একেবারে মৃত্যুশয্যায়।
জবাবে নবীজি কিছুই বললেন না। তত্ক্ষণাৎ উঠে মসজিদ থেকে বেরিয়ে বালকের বাড়ির পথ ধরলেন। উপস্থিত সাহাবিরাও কিছু না বুঝেই নবীজির পিছু পিছু ছুটলেন। তাঁরা আগে কখনো নবীজিকে এতটা অস্থির হতে দেখেননি। যেন তাঁর আপন কেউ অসুস্থ। যেন তাঁর পরিবারের কেউ অন্তিমশয্যায় শায়িত।
নবীজি দোর ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে বালকের শিয়রের কাছে বসলেন। পরম স্নেহে তার মাথায় রহমতের হাতদুটি বুলিয়ে দিলেন। ততক্ষণে বালক নবীজিকে একনজর দেখে নিয়েছে। চোখ বুজে নবীজির হাতের উষ্ণ পরশ উপভোগ করছে। যেন সারা শরীর রহমতের জোয়ারে আন্দোলিত হচ্ছে।
পাশেই তার বাবা বসে আছেন। দেখছেন নবীজি (সা.)-কে। এই কি সেই আরবের নবী মুহাম্মদ (সা.)। এত নুরানি চেহারা। এত সুন্দর মাধুর্য তাঁর। এত মমতায় ভরা তাঁর মন। শুনেছি সে নাকি মুসলমানদের সর্দার। তদুপরি আমার ছোট বাচ্চাকে দেখতেই ছুটে এসেছেন!
নবীজি (সা.)-এর এদিকে কোনো ধ্যান নেই। তিনি ভাবছেন অন্য কিছু। ভাবছেন তার মুক্তির উপায়। ছেলেটি যে এখনো ঈমান আনেনি। এখনো তো সে কালেমা পড়েনি। এই অবস্থায় যদি সে মারা যায় পরকালে কী হবে তার?
নবীজি তার মুখখানা বালকের কানের কাছে নিয়ে গেলেন। বিড়বিড় করে তার কানে ঢেলে দিলেন পবিত্র কলেমার দাওয়াত। উভয় জাহানের সফলতার সোপান। চিরমুক্তির পয়গাম। ‘আসলিম’, হে বালক—ইসলাম গ্রহণ করে নাও! একবার কলেমা পড়ে নাও, যাতে আমি পরকালে তোমায় শাফায়াত করতে পারি। হাউজে কাউসারের পাড়ে যেন তোমার আমার আবার মিলন হয়। মাটির পৃথিবীতে যেমন তুমি আমার সঙ্গে থাকতে। দুজন যেন হতে পারি আখিরাতের সাথি।
বালক ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু সামনেই নিজের বাবাকে দেখে থমকে গেল। অপলক নেত্রে চেয়ে রইল বাবার দিকে। চোখের ভাষায় বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করল জীবনের শেষ ইচ্ছার কথা। একটিবারের জন্য মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র কলেমাটি পড়তে চাই। আমি মুসলমান হয়ে মরতে চাই।
বাবা অনুমতি দিয়ে বলেন, ‘আতি আবাল কাসিম (সা.)’ অর্থাৎ আবুল কাসিম নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কথা মেনে নাও। বালকের বাবার এই কথায় সব নীরবতার অবসান হলো। অসুস্থ বদনখানি কোনো রকম সামলে নিয়ে একফালি হাসি ফোটাল ঠোঁটের কোনায়। চোখের পানি মুছতে মুছতে পবিত্র কলেমা পাঠ করল শরীরের সবটুকু শক্তি উজাড় করে। সঙ্গে সঙ্গে প্রিয় নবীজি (সা.) বলে উঠলেন, ‘শুকরিয়া মহান আল্লাহর, যিনি তাকে আগুন থেকে মুক্ত করলেন।’ (সহিহ বুখারির ১৩৫৬ নম্বর হাদিস অবলম্বনে)
Leave a Reply