ভালোবাসা যুগে যুগে জন্ম দিয়েছে নানা ঘটনার, নানা কিংবদন্তীর। তেমনি এক প্রেমের ঘটনা ঘটেছিল ময়মনসিংহের গৌরীপুরে সম্রাট জাহাঙ্গীর এর শাসনামলে। গৌরীপুরের সখিনা ও ফিরোজ খাঁয়ের প্রেমকাহিনী এখনও মানুষের মনে গেঁথে আছে। প্রেমের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে ফিরোজ নয়, নিহত হন সখিনা।
ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত গৌরীপুর উপজেলার ৭/৮ মাইল দুরে কেল্লাতাজপুর গ্রাম। দেওয়ান উমর খাঁ ছিলেন ওই এলাকার শাসনকর্তা (দেওয়ান)। সখিনা নামে, রূপবতী ও সর্ববিদ্যায় পারদর্শী এক মেয়ে ছিল উমর খাঁয়েরে।
বিবি সখিনার রূপ ও গুণের কথা আশপাশের ৮০/৯০ মাইলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল ।এক পর্যায়ে সখিনার রূপ গুনের খবর জঙ্গলবাড়ির স্বাধীন শাসক,ঈশা খাঁয়ের দৌহিত্র যুবক ফিরোজ খাঁয়ের কান পর্যন্ত পৌঁছায়। ফিরোজ খাঁ সখিনার গুনের কথা শুনে মনের অজান্তেই ভালবেসে পেলেন। এদিকে ফিরোজ খাঁয়ের বীরত্বের কথা শুনে তার প্রেমে পড়ে যান সখিনাও।
সখিনাকে সচক্ষে এক পলক দেখার জন্য কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি হইতে কেল্লাতাজপুরে আসেন ফিরোজ খাঁ। কিন্তু উমর খাঁর অতিমাত্রায় পর্দাপ্রথার জন্য সখিনাকে দেখার বাসনা অপূর্ণই রয়ে যায়।
ফিরোজ খাঁ কৌশলে দবিয়া নামের বিশ্বস্ত সুন্দরী বাদিনীকে ছবি বিক্রয়ের ছলনায় অন্তগৃহে পাঠায়। বাদিনী দবিয়ার মুখে ফিরোজের আবেগময় কথা শুনে কোমলমতি সখিনা বিবি, মনেপ্রাণে এক অলৌকিক প্রেমের টানে পুলকিত হয়ে উঠে। দবিয়া বাদী ফিরে এসে সখিনার মনের ভাব, মুগ্ধকর চেহারার বর্ণনা দেয়।
ফিরোজ খাঁ তার মাতা ফিরুজা বেগমের অনুমতিক্রমে উমর খাঁর কাছে বিয়ের পয়গাম পাঠায়। কিন্তু অহংকারী উমর খাঁ অপমানজনকভাবে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। তখন ফিরোজ খাঁ রাগে, ঘৃণায় অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণে তার বাহিনী নিয়ে অতর্কিত কেল্লাতাজপুর আক্রমণ করে দেওয়ান উমর খাঁকে পরাজিত করেন।
অন্তগৃহের সব মহিলা পলায়ন করিলও সখিনা দৃঢ় ছিল নিজ গৃহে। ফিরোজ খাঁ সখিনাকে বাহুবলে বন্দী করে জঙ্গলবাড়ি নিয়া যায় এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষা, প্রতিকূলতার অবসান ঘটিয়ে বিয়ে করে প্রেমের অমৃতসুধা প্রাণ করেন।
এদিকে উমর খাঁ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আশপাশের শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে সাহায্য চায় এবং বিশাল বাহিনী নিয়ে জঙ্গলবাড়ি আক্রমণ করে বিজিত হয়ে ফিরোজ খাঁকে বন্দী করে নিয়া আসে। সখিনাকে তালাক দেয়ার জন্য বন্দীকে কঠিন চাপ দেয়। কিন্তু ফিরোজ খাঁ তাতে রাজি হননি।
এদিকে দোটানায় পড়ে যান সখিনা। এক দিকে বাবা আর অন্যদিকে স্বামী। কার পক্ষ নেবেন তিনি। শেষে প্রেমের জয় হয়। স্বামীর পক্ষ নিয়ে বাবার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেন সখিনা। ১৮ বছরের এক টগবগে যুবকের বেশ ধরে অধিনায়কের ভূমিকায় যুদ্ধক্ষেত্রে সদর্পে যুদ্ধ করে উমর খাঁর বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে প্রায় পরাজিত করে ফেলেছিল সখিনা।
এমন সময় দেওয়ান উমর খাঁর উজির ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা প্রচার চালায়, ‘ফিরোজ খাঁ সখিনাকে তালক দিয়েছ।’ উজির তালাক নামায় জাল সই করে যুদ্ধের ময়দানে প্রদর্শন করে। এ খবর পৌঁছে যায় সখিনার কানে। তিনি বিহ্বল হয়ে হাত থেকে তরবারি পড়ে যায়। পরে অজ্ঞান হয়ে ঘোড়ার ওপর থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন মাথার মুখোশ খুলে যায়, কেশ গুলি বেড়িয়ে পড়লে সখিনাকে চিনতে পারেন উমর খাঁ। তখন চিৎকার করে আদরের সখিনার ওপর পরে আহাজারি শুরু করেন তিনি।
কিছুদিন পর কেল্লাতাজপুরে বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধি স্থলে এক দরবেশ হাজির হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সমাধিতে বাতি জ্বালাত। আর তার চোখে দিয়ে সারাক্ষণ অশ্রু ঝরতো কারো সঙ্গে কোনো কথা বলতেন না। পরবর্তীতে জানা যায় ওই দরবেশই হচ্ছে ফিরোজ খাঁ। তিনি জমিদারি ত্যাগ করে সহধর্মিণীর মাজারে আলো জেলে প্রেমের জীবন্ত স্বাক্ষর রেখে গেলেন।
সখিনার সেই মাজারের ধ্বংসাবশেষ এখনো কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে কেল্লাতাজপুর গ্রামে। অযত্ন ও সংস্কারের অভাবে মাজার ধ্বংস হতে চলেছে। তবে লোকমুখে এ প্রেমের কাহিনী এখনো ছড়িয়ে আছে।
Leave a Reply