নোবেল কমিটি বলেছে, এই দুই বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে নিখুঁতভাবে জিনোম সম্পাদনার কাজটি সম্ভব করেছে, যার ফলে ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন পদ্ধতি তৈরি হবে।
জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে ডিএনএ সম্পাদনার সূক্ষ্মতম কৌশল উদ্ভাবনের স্বীকৃতি হিসাবে রসায়নে নোবেল পেয়েছেন দু’জন নারী গবেষক – ফ্রান্সের এমানুয়েল শাপেনটিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জেনিফার ডুডনা।
নোবেল কমিটি বলেছে, এই দুই বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে নিখুঁতভাবে জিনোম সম্পাদনার কাজটি সম্ভব করেছে, যার ফলে ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন পদ্ধতি তৈরি হবে। এর ফলে জন্মসূত্রে পাওয়া বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের সুযোগও তৈরি হবে।
জিনোম সম্পাদনা কি অর্থ বহন করে? এটা কীভাবেই বা করা হয়?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বর্ণনা অনুযায়ী, প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীর বংশাণুর বা বংশগতির মৌলিক আণবিক একক হচ্ছে জিন। সন্তান বা উত্তরসূরী পিতা-মাতার কাছ থেকেই একটি করে জিন পায়। ডিএনএ-র (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড) নির্দিষ্ট স্থানে এই জিন বা বংশাণু অবস্থান করে। জীবজগতের বংশগতির ধারক ও বাহক হচ্ছে এই ডিএনএ। ডিএনএ-র মাধ্যমেই জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়। সন্তান যে তার বাবা মায়ের মতো দেখতে হয়, সেটাও এই জিনের কারণে।
জিনোম বলতে আসলে কোন জীবের সামগ্রিক ডিএনএকে বোঝায়। একে সহজভাবে বলা চলে জীবনের নীলনকশা বা কোন জীবের জীবন-বিধান। জীবের বৃদ্ধি, প্রজনন, পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়া সহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে জিনোম ।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোম রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী কিংবা উদ্ভিদ এই ডিএনএ বা জিনোমে গঠিত হয়েছে। ফলে ডিএনএ বা জিনোমের সামান্য পরিবর্তন করে জীব বা প্রাণীর জীবন চক্রের বড় ধরণের পরিবর্তন করা সম্ভব।
তবে জিনোমের পুরোটাই জিন নয়, বরং জিন-এর একটি অংশ মাত্র। জিন বলতে জিনোমের সেই অংশকে বোঝানো হয়, যা নির্দিষ্ট কোন প্রোটিন তৈরির কোড ধারণ করে। যেমন, মানুষের শরীরে তিন বিলিয়ন জোড়া বেইসের মধ্যে জিন রয়েছে মাত্র ২০ হাজারের মতো। এই জিনগুলো সম্মিলিতভাবে মানবের সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।
জিনগত পরিবর্তন-ঘটানো মানবশিশু তৈরি করা কি উচিত?
পাঁচটি বিশেষ ক্ষমতা যা শুধু কিছু মানুষের আছে
জিনোম সিকোয়েন্সিং: শিশু রোগ নির্ণয়ে ‘বিপ্লব’ আসছে
বংশগত রোগ দূর করতে জিন এডিটিং, মানুষের হাতই যখন চাবি
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হিউম্যান জেনোম রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, কোন জীবের শরীরের বিষয় জানতে, তার ক্রুটি শনাক্ত বা দূর করতে হলে আগে তার জিন সম্পর্কে জানতে হবে।
আর জিন সম্পর্কে জানতে বা শনাক্ত করার জন্য প্রথমে তার জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে হবে। জিনোম সিকোয়েন্সিং করার অর্থ হলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডিএনএ অণুর ভেতর বেইসগুলো কিভাবে আছে তা বের করা। বর্তমানে আধুনিক মেশিনের সাহায্যে দ্রুত সেটা করা হয়।
এটা করে জীব বা প্রাণীর ভেতরের জীবন নকশা বের করা হয়। ফলে এরপর বিজ্ঞানীরা সেই জিনোমে বা ডিএনএ-তে পরিবর্তন এনে ক্ষতিকর উপাদান বা ঝুঁকি হ্রাস করার চেষ্টা করতে পারেন।
ফরাসী গবেষক এমানুয়েল শাপেনটিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জেনিফার ডুডনা এই ডিএনএ সম্পাদনার সূক্ষ্মতম কৌশল আবিষ্কার করেছেন।
তারা যে পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে, সেটি হলো ক্রিসপার-ক্যাস নাইন পদ্ধতি। এটি নিখুঁতভাবে জিনোম সম্পাদনার কাজটি সম্ভব করেছে।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে প্রথম এই আবিষ্কার উন্মুক্ত করা হয়। সেখানে বলা হয়, টেস্ট টিউবে ক্যাস নাইন নামের একটি ব্যাকটেরিয়াল এনজাইম টেস্টটিউবে কোষের বাইরে থাকা ডিএনএ কেটে আলাদা করে ফেলতে পারে। সেটাকে যদি চাহিদা মতো নকশায় ক্রিসপার মলিকিউলের সঙ্গে আরএনএ সেগমেন্টের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলে সেটা ডিএনএ-র ক্ষতিকর অংশ শনাক্ত করে সেটাকে আলাদা করে ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীদের জন্য কোন জীব বা প্রাণীর ডিএনএ পরিবর্তন, কোন অংশ বাদ দেয়া, নতুন অংশ সংযোজন করা অথবা জিনোমোর নির্দিষ্ট অংশ পরিবর্তন করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটা দ্রুত, কম খরচের, অনেক বেশি নির্ভুল এবং জিনোম সম্পাদনার অন্যান্য প্রযুক্তির তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ।
আশা করা হচ্ছে, এর ফলে ক্যান্সারের মতো জটিল ব্যাধির চিকিৎসায় নতুন উপায় তৈরি হবে।
জন্মসূত্রে মানুষের পাওয়া অনেক রোগব্যাধি আগেভাগে ডিএনএ বা জিনোম সম্পাদনার মাধ্যমে আগে থেকেই দূর করে দেয়া সম্ভব হবে।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এভাবে জিনোম সম্পাদনা করে ক্ষতিকর অংশ বাদ দিতে পারলে থ্যালাসেমিয়া, মানসিক ব্যাধি, টাইপ-ওয়ান ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, সিস্টিক ফাইব্রোসিস বা ক্যান্সারের মতো বংশগত অনেক রোগ আগেভাগেই রেহাই দেয়া সম্ভব হবে।
যেমন ক্রিসপার-ক্যাস নাইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানব ভ্রূণে থাকা একটি নির্দিষ্ট অংশ কেটে বাদ দেয়ার চেষ্টা করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। ওই অংশটি ক্ষতিকর থ্যালাসেমিয়া রোগের জন্য দায়ী বলে বলা হয়েছে।
এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ২০১৬ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো ‘স্পটি ভেড়া’ জন্ম দিয়েছেন চীনের বিজ্ঞানীরা, যার শরীর পশম অনেকটা গরু ও স্পটি কুকুরের মতো। এখানে আণবিক কাঁচি ব্যবহার করে এক প্রাণীর ডিএনএ কেটে অন্য প্রাণীতে যুক্ত করা হয়েছিল।
তবে এই পদ্ধতির গবেষণা নিয়ে বিতর্ক আছে এই কারণে যে, অনেকের আশঙ্কা, এর ফলে বাবা-মা নিজেদের ইচ্ছামত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে সন্তান জন্ম দিতে চাইতে পারেন। ফলে স্বাভাবিকতা ব্যাহত হবে।
এছাড়া ভ্রূণের পরিবর্তন করা হলে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।
এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে যে, জিনোম সম্পাদনা করে মানুষের উচ্চতা বা বুদ্ধিমত্তার মতো বিষয়গুলো যদি নির্ধারণ করে দেয়া হয়, সেটা নৈতিকভাবে ঠিক হবে কিনা।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জিন পরিবর্তন করে রোগব্যাধি দূর করার বিষয়টি এখনো প্রমাণিত নয়। এখনো এ নিয়ে গবেষণা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে এবং পুরোপুরি নিরাপদ বা কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়নি।
এসব কারণে বিশ্বের অনেক দেশেই এখনো জিনোম সম্পাদনা নিষিদ্ধ।
সংগৃহীত: বিবিসি বাংলা
Leave a Reply