বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, লোকগানের জনপ্রিয় শিল্পী মমতাজ ভারতের গ্লোবাল হিউম্যান পিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। বিডি ফ্যাক্টচেক এর অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ভারতে গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি নামে বৈধ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নাই। তবে এই নামে একটি ওয়েবসাইট আছে যারা টাকার বিনিময়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়ে থাকে যা ভারতের দ্যা ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন (ইউজিসি) অ্যাক্ট- ১৯৫৬ অনুযায়ী অবৈধ।
কন্ঠশিল্পী মমতাজের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রাপ্তি নিয়ে প্রথম আলোর শিরোনাম: সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন মমতাজ
বাংলা ট্রিবিউনের শিরোনাম: ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন মমতাজ
ইত্তেফাকের শিরোনাম: ‘ডক্টর অব মিউজিক’ ডিগ্রি পেলেন মমতাজ
দ্যা ডেইলি স্টারের শিরোনাম: Momotaz awarded honourary doctorate in India
ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত ডিগ্রির সনদ হাতে মমতাজ
সবকয়টি সংবাদ মাধ্যমে মোটামুটি একই বক্তব্য এসেছে।
শনিবার (১০ এপ্রিল) ভারতের তামিলনাড়ুর গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মাননাসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংসদ ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজ। সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়, “বিশ্বের প্রথম শিল্পী হিসেবে ৭০০টির বেশি একক অ্যালবামের রেকর্ড, সুদীর্ঘ ৩০ বছর বাংলা গানকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা ও সমাজসেবা ছাড়াও নানামুখী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রেখে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন মমতাজ। যে কারণে তারা বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শনিবার ‘ডক্টর অব মিউজিক’ পদক প্রদান করে। এটি দেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ড. পি. ম্যানুয়েল। এর ফলে বহু সম্মানে ভূষিত এ শিল্পী প্রথমবারের মতো ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন।”
ফ্যাক্টচেক
গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়:
ভারতের দ্যা ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন (ইউজিসি) অ্যাক্ট- ১৯৫৬ এর সেকশন ২২(১) অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় অথবা রাজ্য সরকার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, অথবা ইউজিসি অ্যাক্ট-১৯৫৬ এর ৩ এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়, অথবা সংসদীয় কোনো আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানই শুধু ডিগ্রি প্রদান করতে পারবে। ইউজিসি অ্যাক্ট-১৯৫৬ এর সেকশন ২৩ এ বলা হয়েছে, উপরিউক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া আর কেউ “বিশ্ববিদ্যালয়” শব্দটি ব্যবহার করতে পারবে না। গ্লোবাল হিউম্যান পিস বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের ইউজিসি অ্যাক্ট-১৯৫৬ অনুযায়ী কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই নয় এবং এটি কোনো ডিগ্রিও প্রদান করতে পারে না।
ভারতের ৯৭৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি:
ভারতে মোট ৯৭৯টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্র পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় ৫৪টি, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় ৪২৫টি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ৪২৫টি, এবং ইউজিসি অ্যাক্ট-১৯৫৬ এর তিন সেকশন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ্য করা হয় আরও ১২৫টি প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটির কোনো নাম নেই। দেখুন পুরো তালিকাটি।
গোলমেলে ডোমেইন নাম:
গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটির নামে একটি ওয়েবসাইট (ghpuedu.org) পাওয়া গেছে। সাধারণত বিশ্বের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের ডোমেইন ডটএডু (.edu) দিয়ে শেষ হলেও এর নামের শেষে রয়েছে ডটওআরজি (.org) যা কেবল বিভিন্ন সংস্থার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ডোমেইন যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান হুডটইজ (who.is) এ দেখা গেছে, ghpuedu.org এই ডোমেইনটির নিবন্ধন করা হয়েছে ২০১৯ সালের তিন সেপ্টেম্বর। এই বছরের তিন সেপ্টেম্বর সাইটটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সাধারণত প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডোমেইনের নিবন্ধন অনেক বছরের জন্য করা হয়। সেই তুলনায় এই ডোমেইনটি নতুন এবং মাত্র একবছরের জন্য নিবন্ধন করা হয়েছে।
ঠিকানা ভুল:
গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট ঘেটে এর স্থায়ী ক্যাম্পাসের কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়নি। তবে তাদের কিছু আঞ্চলিক কেন্দ্রের ঠিকানা দেওয়া আছে। এই ঠিকানাগুলো গুগল ম্যাপে সার্চ করে এই সম্পর্কিত কোনো কিছু পা্ওয়া যায়নি। অর্থাৎ ঠিকানাগুলো ভূয়া। এছাড়া ইতালি, সৌদিআরব ও জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির আঞ্চলিক অফিস থাকার কথা উল্লেখ করলে ওয়েবসাইটে কোনো লিংক কিংবা ঠিকানা দেয়া হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে কলকাতার একটি ঠিকানা ব্যবহার করা হলেও এই ঠিকানায় বিশ্ববিদ্যালয়টির কোনো অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়নি।
নেই কোনো আন্ডারগ্রাজুয়েট ও গ্রাজুয়েট ডিগ্রি:
গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা যাচ্ছে, এখান থেকে কোনো আন্ডারগ্রাজুয়েট ও গ্রাজুয়েট ডিগ্রি দেওয়া হয় না। শুধু কিছু অনলাইনভিত্তিক কোর্সের লিংক দেয়া আছে। এছাড়া সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয় অনেকগুলো বিষয়ে। বিশ্বে এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নাই যেখানে আন্ডারগ্রাজুয়েট ও গ্রাজুয়েট ডিগ্রি না দিয়ে শুধু সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়া হয়।
টাকার বিনিময়ে পিএইচডি
গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি’র ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সম্মানসূচক পিএইচডি’র প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী পেইজে বলা হয়েছে, “To raise funds for charity and to cover research development expenses the details of which may be given in the university website.” অর্থাৎ চ্যারিটি কিংবা গবেষণা উন্নয়ন ব্যয়ের ফান্ড যোগাড় করার জন্য তারা সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে।
সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কোনো প্রসেসিং ফি নেয় কিনা এর উত্তরে তারা লিখেছে, “Yes, this the university collects to cover the expenses of a public function and a wide press coverage for the awardees if it is conducted.” অর্থাৎ তারা অনুষ্ঠান এবং মিডিয়া কাভারেজের জন্য সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি যাদেরকে দেয়া হয় তাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে থাকে। এছাড়া প্রশাসনিক ব্যয়, উদযাপন ব্যয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বিভাগকে তহবিল সরবরাহের জন্য ফি প্রদান করতে হয়। সহজ কথায় টাকার বিনিময়ে সম্মানসূচক ভূয়া ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়ে থাকে এটি।
সিদ্ধান্ত:
গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি ভারতের আইন অনুযায়ী অবৈধ প্রতিষ্ঠান। এমনটি ভারতে এই নামে কোনো বৈধ বিশ্ববিদ্যালয় নাই। এটি টাকার বিনিময়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে থাকে।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply