ষাটের দশকের শেষ থেকে সত্তরের দশকের শুরু পর্যন্ত আমার ছাত্রজীবনে এবং পরবর্তীতে ৫২ বছরের সাংবাদিকতা-জীবনের পুরোটা সময়জুড়ে আমি দেশের উন্নয়ন কৌশল ও কীভাবে বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যত নিয়ে পরিকল্পনা করেন, তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। আমাদের সবচেয়ে বড় দুই সম্পদ যে দেশের জনগণ ও নদ-নদী—তা অনুধাবন করতে খুব বেশি চিন্তার প্রয়োজন হয় না। আমি সব সময়ই অবাক হয়ে ভেবেছি যে, কেন আমাদের পরিকল্পনাবিদরা এই দুই সম্পদকে তাদের সব ভাবনা ও পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখেননি।
মানচিত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, আমাদের নদ-নদীগুলোর বিস্তৃতি কতটা এবং কীভাবে এগুলো দেশের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছেছে। এটি প্রায় মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্রের মতো, যার মাধ্যমে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত দেহের প্রতিটি অঙ্গে প্রবাহিত হয়ে আমাদের জীবিত ও সুস্থ রাখে।
একটু ভাবুন, এই নদীগুলোর মাধ্যমে আমরা কত কিছুই না করতে পারতাম। বাংলাদেশের প্রতিটি অংশে খুব সহজে মানুষ, পণ্য ও সেবা পৌঁছে দেওয়া যেত। দেশের সব স্তরের মানুষ এটি ব্যবহার করতে পারত। যার ফলে এটি হতে পারত সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও বৈষম্যহীন একটি পরিবহন ব্যবস্থা। সর্বোপরি, জলবায়ু সংকট মাথায় রেখে বলা যায়, এটি খুবই পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা হতো। এই নদীগুলো আমাদের যোগাযোগের জন্য এক ধরনের প্রাকৃতিক অবকাঠামো। অবশ্যই দেশজুড়ে সড়ক নির্মাণের প্রয়োজন আছে। তবে নদীভিত্তিক নেটওয়ার্ক তৈরি করা হলে যোগাযোগে ক্ষেত্রে তা সবচেয়ে আকর্ষণীয়, কার্যকর ও দরিদ্রবান্ধব বিকল্প হতে পারতো।
কিন্তু তা না করে আমরা নদীগুলোর সঙ্গে যে আচরণ করেছি তা অচিন্তনীয়, ধ্বংসাত্মক ও প্রায় আত্মঘাতী। আমরা কখনোই এগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করিনি এবং কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিকল্পনা করতে পারিনি, যার মাধ্যমে নদীগুলো আমাদের সার্বিক উন্নয়ন কৌশলের অংশ হতে পারে। এমনকি আমরা এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক কাজগুলোও করিনি। নদীগুলোকে যথাযথভাবে খননই করা হয়নি। ফলে বছরের পর বছর পলি জমে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে এবং এর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি, আমরা পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ছাড়াই বাঁধ, কালভার্ট, স্লুইসগেট ও উঁচু সড়ক নির্মাণ করেছি। যার ফলে পানির প্রবাহ ঠিকমতো বজায় থাকেনি এবং কখনো কখনো অপরিকল্পিতভাবে এর গতিপথ বদলেছে, যা সার্বিকভাবে নদীগুলোর ক্ষতি করেছে।
তারপর আমরা এগুলোতে বিষ ঢেলেছি। সব শহরের সমস্ত নর্দমার শেষ গন্তব্য এই নদীগুলোই। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিপর্যয় তৈরি হয়েছে কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থের ভাগাড় হিসেবে নদীর ব্যবহারে। ভাবুন, লাখো টন বিষাক্ত বর্জ্য আমাদের সুন্দর, জীবনদায়ী, খাদ্য সরবরাহকারী নদীগুলোতে নিরবচ্ছিন্নভাবে বছরের পর বছর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যা সেই নদীগুলোর প্রাণশক্তি কেড়ে নিয়েছে। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে আমরা নিজেরাই নদীগুলোকে হত্যা করেছি।
দেশে নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার ২০০ ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীতে তা কমে ৭০০ এবং বর্তমানে আনুষ্ঠানিক হিসাবমতে সংখ্যাটি মাত্র ৪০০-তে এসে দাঁড়িয়েছে। যদিও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৯০৭। আমাদের অবহেলা সত্ত্বেও যে নদীগুলো এখনো টিকে রয়েছে, সেগুলো এতটাই দূষিত যে, কোনো কোনোটিতে রাসায়নিক বর্জ্যের প্রাচুর্যে ব্যাকটেরিয়াও বেঁচে থাকতে পারে না। আমাদের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া শুরু থেকেই প্রকৃতিবিরোধী। এই প্রক্রিয়া টেকসই হতে পারে না। এভাবে আমরা আমাদের ভবিষ্যতকে বিপদসংকুল করে তুলছি।
আমাদের উপেক্ষার অপর উপাখ্যান জনসম্পদকে ঘিরে। আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ আমাদের জনগণ; বিশেষত, তরুণ-তরুণীরা। আমরা সবাই জানি যে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশের অন্যতম। কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা, প্রয়োজনীয় দক্ষতা, প্রশিক্ষণ ও উপযুক্ত প্রযুক্তিগত উপকরণ দিতে পারলে একইসঙ্গে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে উৎপাদনশীল দেশগুলোর কাতারে নাম লেখাতে পারতাম। তা না করে আমরা দেশের তরুণ-তরুণীদের ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছি।
মানব ইতিহাসে যে মুহূর্ত থেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি উৎপাদন শুরু হলো, তখন থেকেই সম্পদ জমিয়ে রাখার প্রবণতার শুরু। আমরা জাতিতে জাতিতে ভাগ হতে লাগলাম, আলাদা আলাদা দেশ তৈরি করলাম। একেকটি দেশ কতটুকু সম্পদশালী হবে, তা সেই দেশের নাগরিকদের উৎপাদনশীলতার ওপর নির্ভর করত। শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে উৎপাদনশীলতা নতুন মাত্রায় পৌঁছাল এবং প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা দেশগুলো ধনী হলো। এই ইতিহাস থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই।
২১ শতাব্দীর চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়ে আমরা দেশের মানুষকে দক্ষ করে তুলতে পারিনি। যার ফলে তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর আধুনিক বিশ্বে বিচরণের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি এবং বাধ্য হয়ে বিদেশে যেয়ে নিম্নপদের, কম দক্ষতার চাকরি নিতে বাধ্য হচ্ছে। ভেবে পাই না কীভাবে আমরা শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ না করে দেশের মানুষকে কাজের দক্ষতা ও উদ্যোক্তাসূলভ মনোভাব অর্জন থেকে বঞ্চিত করেছি। সঠিকভাবে বিনিয়োগ করা হলে আধুনিক বিশ্বের অকল্পনীয় সম্ভাবনার দুয়ার আমাদের সামনে উন্মুক্ত হতে পারত।
আধুনিক বিশ্ব হচ্ছে চিন্তা-চেতনার জগত—এ বিষয়টিকে আমরা কীভাবে এড়িয়ে গেলাম! অবশ্যই অবকাঠামোর প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু সৃজনশীলতার প্রয়োজন আরও অনেক বেশি। কীভাবে আমরা অনুধাবন করলাম না যে গুগল, অ্যামাজন, উবার, এয়ারবিএনবি, মাইক্রোসফটের মতো বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের মূলে রয়েছে শুধুই বিকল্প না নতুন চিন্তাধারা? এমনকি, কিছু অসামান্য ফোন নির্মাণের জন্য প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের সাফল্যের মূলেও রয়েছে সেই উদ্ভাবনী চিন্তাধারা।
আমি প্রায়ই ভাবি, স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের যাত্রা শুরুর পর থেকে গত ৫৩ বছর আমাদের শিক্ষা খাতের অর্জন কী? ১৯৭১ সালের পর থেকে আমরা বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু এসব উদ্যোগের ফলাফল কী ছিল? ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত কুদরত-ই-খুদা কমিশনের লক্ষ্য ছিল এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা, যা নতুন জাতিকে ঔপনিবেশিক আমলের অতীত ও এর পাকিস্তানি সংস্করণের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে সহায়তা করবে। একের পর এক শিক্ষা কমিশন গঠনের উদ্যোগ এখানেই থেমে থাকেনি, এসেছে ১৯৯৮ সালের মফিজউদ্দিন কমিশন, ১৯৯৭ সালের শামসুল হক কমিশন, ২০০০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ও ২০১০ সালের কবির চৌধুরী কমিশন।
প্রথমটি ছাড়া, বাকি একটি শিক্ষা কমিশনও দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আনার জন্য মতো উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ হলো রাজনৈতিক দৃশ্যপটের কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, যার মাধ্যমে উল্লেখিত কমিশনগুলোর যাচাই-বাছাই এবং পরবর্তীতে, যা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলেছে।
অন্য সবকিছুর মতোই বাংলাদেশে শিক্ষারও বড় আকারে রাজনীতিকরণ হয়েছে। প্রত্যেক শাসক নিয়ন্ত্রণ ও স্কুলের পাঠক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন ও ধ্যানধারণা আরোপের চেষ্টা চালিয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশিদিন ধরে দেশ শাসনের কারণে অত্যন্ত ক্ষতিও করেছে আওয়ামী লীগ। ওই শাসকের অন্যতম রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল তাদের আমলে শিক্ষার্থীরা আগের তুলনায় আরও উন্নতমানের শিক্ষাগ্রহণ করেছে—তা সবার কাছে দৃশ্যমান করা। এ কারণে গুণমানের চেয়ে সংখ্যা বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করে এবং প্রতি বছর আগের বছরের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষাগুলোতে পাস করতে থাকে। এক্ষেত্রে শিক্ষার গুণমান ও শৃঙ্খলার বিষয়গুলো বড় আকারে উপেক্ষিত থেকে যায়।
পরবর্তীতে স্পষ্ট হয় যে, পরীক্ষায় পাস করা অর্থহীন হয়ে পড়েছে এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার ভার নিতে পারছে না। এ পর্যায়ে এসে গুণমানের দিকে নজর বাড়তে শুরু করে। তবে ততদিনে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে এবং ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনার বিষয়টিতে ফিরে যেয়ে বর্তমান নেতৃত্বকে বলতে চাই, পরিশেষে এই দুই সম্পদ—নদী ও মানুষকে গুরুত্ব দিন—যা আমাদের টেকসই ও প্রগতিশীল ভবিষ্যত গড়ার মাধ্যম হতে পারে। বিশ্ব এখন যে অনিশ্চয়তার মুখে রয়েছে, সেখানে একটি সুশিক্ষিত, প্রকৃতপক্ষে দক্ষ ও সুপ্রশিক্ষিত জনসম্পদ গড়ে তোলাই হবে সবচেয়ে উপযুক্ত উন্নয়ন নীতিমালা।
আমরা সদাপরিবর্তনশীল পৃথিবী, বিপুল সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, নজিরবিহীন সামাজিক রূপান্তর এবং সর্বোপরি, অজানা ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু জাতি হিসেবে এসব বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য আমরা পুরোপুরি অপ্রস্তুত।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে যে নতুন নতুন সুযোগ আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয়েছে, সেগুলোকে উদযাপনের পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে আমাদেরকে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার দিকে নজর দিতে হবে। আমরা যে দুইটি সম্পদের কথা এ লেখায় উল্লেখ করেছি, সেগুলোতে মনোযোগ দেওয়াই হবে সেরা বিকল্প।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Leave a Reply