চিপাচাপায় আড্ডা দিয়ে রংবাজ খেতাব জুটিয়েছি অনেক আগেই। শব্দের মূল অর্থ থেকে বেরিয়ে যখন আলাদা রং চড়ানো হয় সুখকর ব্যাপার থাকে না। বদনাম ঘোচানোর জন্য অনেকে গরু-মোষ জবাই করে মানুষকে খাওয়ায়। ভূরিভোজের পর তারা নতুন নামে ব্যবহার করে।
আমিও যদি এ পন্থা নিই, অন্যের গবাদি পশুই ছিনিয়ে আনতে হবে। তাতে রংবাজ শব্দটা আরও চাউর হবে! খবরটা হয়তো পৌঁছে যাবে থানা এবং বাসা পর্যন্ত। তার চেয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে নামটা চাপা দেওয়া ভালো। ভাবতে ভাবতে এসে গেল মোক্ষম বুদ্ধি। বাজার থেকে বাকিতে কিনে আনলাম অনেক রং বেনীআসহকলা! রংধনু রঙে সাজালাম নিজেকে। মেকআপম্যান আমার বন্ধু ছগির। চুক্তি হয়েছে, প্রতিদিনই সে সাজাবে, আমার রংবাজ পরিচয় থেকে কালো রংটা নেমে গেলে ওকে আমি সাজিয়ে দেবো। রংস্নানে শুচি হবে মহল্লা।
প্রথম দিন মেকআপ নেওয়ার পর প্রত্যাশিত প্রশ্নতোড় ভেসে আসতে থাকে কী রে, কোথায় ধরা খাইছিস?
সঙ সাজছস ক্যান!
স্কুলে না পড়েই র্যাগ ডে উদযাপন করলি নাকি!
সবার প্রশ্নের উত্তর একটাই ‘আমি রংবাজ!’
রংবাজের নতুন বেশবাস এলাকাবাসী হজম করতে পারছে না। আমিও চর্চা থামাই না ফিরতে হবে শেকড়ে-মূলে।
অন্যের কুৎসা রটানো, চরিত্রে কালিমা লেপনের মতো আনন্দের কাজ পৃথিবীতে নেই। পরনিন্দা ও পরচর্চার উৎসবে কে শামিল না হয়! বন্ধুবান্ধবের আড্ডায়, সর্বত্র আমরা প্রায়ই পরচর্চা করতাম। হয়তো দেখলাম, প্রতিবেশী আব্বাস আংকেল ও বিলকিস আন্টি এক রিকশায় যাচ্ছেন। এটাকে রং মাখিয়ে বানালাম তারা দুজন পার্কে বসে বাদাম খাচ্ছিলেন। আংকেল একহাতে নুন-মরিচ রেখে অন্য হাতে আন্টিকে খাইয়ে দিয়েছেন!
এসব খবর ছড়াতে সময় লাগে না। যাদের নামে বলা তাদের কানেও চলে যায় দ্রুত। তারা বিব্রত হতেন, আমরা বেপরোয়া। পরচর্চা যদি বন্ধ করি আড্ডা কীভাবে জমবে! কিন্তু এ আড্ডাই যে প্রেমের ক্ষেত্রে কাল হয়ে দাঁড়াবে কখনো ভাবিনি। রংবাজ ছেলেদের প্রতি মেয়েরা অনুরক্ত ছোট থেকেই সিনেমায় দেখে এসেছি। বাস্তবেও কম দেখিনি। নিজের ক্ষেত্রে কাজে আসবে না এটা অচেনা বিস্ময়!
মহল্লার টিয়াকে সেদিন বলেই ফেললাম জমানো কথাটি, ‘আমি তোমাকে ভালো পাই।’
সে বলে উঠল, ‘রংবাজের শখ কত!’
কবে রংবাজ হলাম! গল্পগুজব করা, আড্ডা দেওয়া, অন্যের ছিদ্রান্বেষণে চায়ের স্বাদ বাড়ানো এতই দোষের! তারপরও অনেকবার চেষ্টা করেছি টিয়ার মন পেতে। শুনতে হয়েছে কটূক্তি ‘দরকার হইলে কুত্তার লগে প্রেম করুম তবু ছদরুল রংবাজের লগে না!’
সুস্পষ্ট অপমান। সে দিন রাতেই রাস্তা থেকে ১০টা বেওয়ারিশ কুকুর এনে ঢুকিয়ে দিয়েছি ওদের গ্যারেজে। বাড়ির গেটে তালা মেরে চাবিটা ফেলে দিয়েছি ড্রেনে। কর এবার কুত্তার লগে প্রেম!
ঘটনা আঁচ করতে পেরে টিয়া বিরাট হাউকাউ লাগিয়ে দিল। ৯৯৯ নম্বরে কল দিতে গিয়ে আমাকেই কল করে বসল। নম্বর দিয়েছে সচেতনতামূলক দেয়াল লিখন থেকে! অভিযোগ অস্বীকার করে বললাম, ‘আমার বিষয়টা একটু ভাইব!’ পরদিন টিয়ার বাবা আমার বাবাকে শাসালেন ‘রংবাজ ছেলের পরিচয় দিতে লজ্জা করে না?’
বাবা উল্টো শুনিয়ে দিলেন ‘রংবাজ নয়, ছেলে আমার আড্ডাবাজ!’
সে রাতটা আমার ভালো কাটেনি। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় পাল্টে গিয়েছিল গায়ের রং, মুখের জ্যামিতি। তখনই শপথ নিলাম, রংবাজ পরিচয় বহাল রাখব, মন্দ কথা না শুনেই!
আড্ডাবাজি কমিয়ে রংবাজিতে বেশি সময় দেওয়ার ফলে মানুষের মুখে হাসি ফিরেছে। তারা এখন আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার বদলে হাসে। একটুও খারাপ লাগে না। রং মেখে কয়েকদিন চক্কর কেটেছি টিয়ার কলেজের সামনে। দারোয়ান পরিচয় জানতে চাইলে বলেছি, ‘রংবাজ!’ হকচকিয়ে গিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি সে।
আজও টিয়াকে রংবাজ চেহারাটা দেখাতে মন চাইলো। মহল্লার বাইরে যাওয়ার আগেই পেছন থেকে টিয়ার ডাক ‘এই রংবাজ!’
সামনে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরল সে ‘তোমার রংগুলো একদিন নিয়ে এসো তো, আমি সাজব!’
ধাতস্থ হয়ে বললাম, ‘মহিলা রংবাজ হবে নাকি?’
‘না। পুরুষ রংবাজের সঙ্গিনী হব!’
Leave a Reply