দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। গত সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই মাঠের রাজনীতি নেই বললেই চলে। করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী মহামারি রূপে দেখা দেওয়ার পর বাংলাদেশে রাজনীতি একেবারেই ঘরে ঢুকে গেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার অবস্থা কোনো দলেরই এখন আর আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা খুবই খারাপ। আন্দোলন করে দাবি আদায়ের সক্ষমতা এই দলটির এখন নেই। বক্তৃতা-বিবৃতিতে দলের মহাসচিবসহ কেউ কেউ মাঝেমধ্যে হুংকার ছাড়েন বটে, কিন্তু সরকার কিংবা সরকারি দল তা আমলে নেয় না। বিএনপির অক্ষমতা সরকারের জানা। বিএনপির আন্দোলনের ডাকে মানুষ সাড়া দেয় না। এমনকি বিএনপির নেতাকর্মীরাও দীর্ঘদিন থেকেই দলের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ছেড়ে দিয়েছে। নেতাকর্মীরাও বুঝেছে যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো সহজ কাজ নয়।
বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের পক্ষে দেশ কাঁপানো আন্দোলন গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা তার মিত্র দলগুলোতেও সংক্রমিত হয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটও এখন নিষ্ক্রিয়। বিএনপি জোটের বড় শক্তি ছিল জামায়াতে ইসলামী। সরকারি চাপ এবং হয়তো কৌশলগত কারণে জামায়াত কয়েক বছর থেকেই বিএনপির সঙ্গে দহরমমহরম কমিয়ে দিয়েছে। বিএনপির কথা অনুযায়ী চলার নীতি থেকে জামায়াত সরে এসেছে। জামায়াত তলে তলে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য গোপনে তৎপর থাকলেও বিএনপির সহায়ক শক্তি হিসেবে সম্ভবত দাঁড়াতে চায় না। জামায়াত-বিএনপির মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি হলে তাতে ক্ষতি হয় বিএনপির। কেউ কেউ মনে করেন, দেশে দৃশ্যত এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। আর তার সুফল ঘরে তুলছে জামায়াতে ইসলামী।
আদর্শবাদী, ত্যাগী নেতাদের বাইরে রেখে বিতর্কিতদের নিয়ে চলা, তাদের কমিটিতে রাখার নীতি বা কৌশল বদলাতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে দলের শক্তি এবং দুর্বলতা বোঝার রাজনৈতিক পরিপক্বতা অর্জন করতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীরা ওঁৎ পেতে আছে, তাদের সুযোগ করে দেওয়া চলবে না। চিহ্নিত অপরাধীরা কীভাবে আওয়ামী ছাতার নিচে আশ্রয় পাচ্ছে? শাক দিয়ে মাছ ঢাকার পুরনো কৌশল পরিহার করে সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
মাঠে সরকারবিরোধী আন্দোলন নেই বলে আওয়ামী লীগ বা সরকার হয়তো এক ধরনের স্বস্তিতে আছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গুমোট রাজনৈতিক হাওয়া ভালো লক্ষণ নয়। বর্তমানে শেখ হাসিনার চেয়ে জনপ্রিয় নেতা বা নেত্রী আর কেউ নেই। একসময় খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা ছিল কাছাকাছি। কার চেয়ে কার পাল্লা ভারী- তা বড় বিতর্কের বিষয় ছিল। কখনো কখনো মনে হতো ব্যক্তিগতভাবে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাই হয়তো বেশি। খালেদা জিয়া দেশের যেখান থেকেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, সেখান থেকেই জয়লাভ করেছেন। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। কিন্তু গত কয়েক বছরের রাজনীতির উত্থান-পতনে দুই নেত্রীর অবস্থানও বদলেছে। শেখ হাসিনা ক্রমাগত তার অবস্থান সংহত করেছেন। তিনি শাসক হিসেবে যেমন অধিক দক্ষ বলে প্রমাণ করতে পেরেছেন, তেমনি মানবিক দিক থেকেও অনেক বেশি সংবেদনশীল, এটা আর এখন খুব বিতর্কের বিষয় নয়। তিনি যতটাই ‘গেইন’ করেছেন, খালেদা জিয়া ততটাই ‘লস’ করেছেন।
শেখ হাসিনা রাজনৈতিক কৌশল, দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞায় খালেদা জিয়াকে পেছনে ফেলেছেন।
শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবে এখন আর সেভাবে খালেদা জিয়ার কথা মানুষ বিবেচনা করেন বলে মনে হয় না। যেহেতু মানুষ চোখের সামনে ভালো বিকল্প দেখে না, সেহেতু সরকারবিরোধী আন্দোলনও দানা বাঁধে না। এই অবস্থা কতদিন চলবে, আওয়ামী লীগের শাসন আরো কতদিন নির্বিঘ্ন থাকবে, তা নিয়ে অবশ্য আলোচনা ও বিতর্ক আছে।
আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে । শেখ হাসিনা এবার নিয়ে চতুর্থ বার দেশের প্রধানমন্ত্রী। এবার মেয়াদ শেষে আবারও কি শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী হবেন? আপাতত তাকে বাদ দিয়ে কোনো আলোচনা বাজারে নেই। এত লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড আমাদের দেশে আর কারো নেই। আওয়ামী লীগের যারা বিরোধী তারা বলে থাকেন, আওয়ামী লীগ যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি। গত দুইটি নির্বাচনে মানুষ সত্যিকারভাবে ভোট দেওয়ার অধিকার পায়নি। ভোটকেন্দ্র দখল, ভুয়া ভোট এবং আরো নানা অপকৌশলে নৌকার প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তো ১৫২ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপিসহ নিবন্ধিত বেশিরভাগ দল ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণই করেনি। পরের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ভোট সুষ্ঠু হয়নি। বলা হয়, প্রশাসনের সহায়তায় আওয়ামী লীগ বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। নির্বাচন কমিশন মানুষের আস্থা-বিশ্বাস হারিয়েছে। পরের নির্বাচনও যদি একই ধারায় করার পরিকল্পনা থাকে তাহলে সেটা খুব ভালো হবে বলে মনে হয় না। মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে কীভাবে জয়ী হওয়া যাবে, সে চেষ্টাই এখন থেকে করতে হবে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিকভাবে দেশ অনেক এগিয়েছে, বিদেশিরাও বাংলাদেশের উন্নতি-অগ্রগতির প্রশংসা করছে। করোনাকালেও দেশের অর্থনীতি ভঙ্গে পড়েনি কিন্তু একটি কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় দেশে সুশাসনের ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। একধরনের প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা প্রবল হয়ে উঠেছে। জনগণের ভোটের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না বলে সরকারের ওপর আমলাতন্ত্রের প্রভাব বেশি। বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্নীতি। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে, অসন্তোষ আছে। কিন্তু প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবে মানুষের সংগঠিত প্রতিবাদের সুযোগ নেই।
এই অবস্থায় দেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির পরিকল্পিত পাঁয়তারা চলছে বলে সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে। নানা ধরনের গুজব ছড়ানোর অপচেষ্টা আছে, আছে উস্কানি। খোলামেলা পরিবেশ না থাকলে মানুষ গুজব ও কান কথায় বিশ্বাস করে। যেকোনো অরাজনৈতিক অপতৎপরতা মোকাবিলা করতে হলে অবাধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অপরিহার্য। কিন্তু রাজনীতিটা কেমন যেন একটি নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় চলে গেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে সুস্থ ধারায় অগ্রসর হচ্ছে, সেটাও বলা যাবে না। মূল দল এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সম্মেলন হয়, কিন্তু দীর্ঘ সময় পরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা সম্ভব হয় না। কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ সংঘর্ষেও রূপ নেয়। আওয়ামী লীগের মধ্যে পাওয়া না-পাওয়ার কোন্দল-বিরোধ এখন তুঙ্গে। যারা দল ক্ষমতায় থাকার সুযোগে নানা দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছ তারা আরো পাওয়া এবং খাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে যারা বঞ্চিত আছে তারাওতারাও পাওয়ার আশায় বেপরোয়া। বিরোধী দলকে বাগে রাখা গেলেও আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছ না। নানা অপরাধ-অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে আওয়ামী পরিবারের কিছু সদস্য। শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েও দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারছেন না। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে সরকারের জন্যই বিপদ বাড়বে।
করোনার কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়েছে। আয়-উপার্জন কমছে অনেক মানুষের। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে কারণ ছাড়াই। চাল-ডাল-তেল, পেঁয়াজ, আলু, সবজি -সবকিছুরই বাজার চড়া। সরকারের বেধে দেওয়া দামে ক্রেতারা আলুটাও কিনতে পারছে না। রাজনীতিকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। একশ্রেণীর ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর কাউকে তোয়াক্কা করছে না। সব জায়গায় গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে সব কিছু। সাধারণ মানুষের আয় কমছে, ব্যয় বাড়ছে। কোটি কোটি মানুষ দুঃখ-কষ্টে আছে। মানুষের কষ্ট লাঘবের উদ্যোগ-প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হয়ে না উঠলে রাজনীতি শান্ত না-ও থাকতে পারে। কথায় আছে, পেটে খেলে পিঠে সয়। মানুষ পেট ভরে খেতে না পেলে বাইরের কাউকে উস্কানি দিতে হবে না।
যারা শাসন করছেন, তাদের এসব কিছুও ভাবতে হবে। নজর রাখতে হবে সব দিকেই। রাজপথ উত্তপ্ত নয়, তাই সব ঠিক আছে – এই আত্মতৃপ্তি একসময় আত্মঘাতীও হতে পারে। নিজের ভালো নাকি পাগলেও বোঝে! আওয়ামী লীগ কি তা বুঝতে পারছে? সব বিপদে শেখ হাসিনাই ত্রাতা হিসেবে থাকবেন, এই ধারণা নিয়ে যারা হাতপা গুটিয়ে আছেন, তাদের পরে পস্তাতে হতে পারে। শেখ হাসিনা এখন আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তার দৌড়ে আওয়ামী লীগকেও এগেয়ে যেতে হবে। আদর্শবাদী, ত্যাগী নেতাদের বাইরে রেখে বিতর্কিতদের নিয়ে চলা, তাদের কমিটিতে রাখার নীতি বা কৌশল বদলাতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে দলের শক্তি এবং দুর্বলতা বোঝার রাজনৈতিক পরিপক্বতা অর্জন করতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীরা ওঁৎ পেতে আছে, তাদের সুযোগ করে দেওয়া চলবে না। চিহ্নিত অপরাধীরা কীভাবে আওয়ামী ছাতার নিচে আশ্রয় পাচ্ছে? শাক দিয়ে মাছ ঢাকার পুরনো কৌশল পরিহার করে সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
Leave a Reply