বন্যার পর গাইবান্ধার খাল বিল ও জলাশয়গুলোতে এখন শুরু হয়েছে মাছ ধরার মৌসুম। সেই সাথে শুরু হয়েছে এলাকার ঐতিহ্যবাহী দলবদ্ধ মাছ শিকার ‘বৈদ’ বা ‘বৈত’। সোমবার সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের ঝিনিয়ার বিল ও কুপতলা ইউনিয়নের নলিগলির বিলে মাছ শিকারের মধ্য দিয়েই এবার শুরু হয়েছে ‘বৈদ’ নামে দলবদ্ধ মাছ শিকারের পর্ব। কর্মব্যস্ত মানুষের জীবন থেকে ক্রমাগত হারিয়ে যাওয়া এই উৎসবে ছুটির দিনে অংশ নেন নানা পেশার মানুষ।
তাদের হাতে, কাঁধে নানা ধরনের মাছ ধরার উপকরণ পলো, হ্যাংগার জালি, পলো জালি, হ্যাগা, মুঠ জাল, কোঁচ, ক্যাটা, তৌরা জাল, ঝাঁকি জাল। খবর পেয়ে স্থানীয় সংবাদিকদের একটি দল সেখানে গিয়ে এই চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করেন।
পেশায় কম্পিউটার ব্যবসায়ী আতোয়ার রহমান। কাজে যাবার আগে পলো নিয়ে নেমে পড়েছেন বিলে। ভাগ্যক্রমে তিনি পেয়েছেন মাঝারি সাইজের দুটো কারফ্যু মাছ। আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললেন, এই দলে কম করেও তিন-চার শ মানুষ আছেন। শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়, ছাত্র, কৃষক সবাই আজ মিলেমিশে একাকার। এদের কারো কারো বয়স ৬৫ ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু দেখেন, মাছ মিলুক আর না মিলুক কিভাবে মাছের নড়াচড়া টের পেয়েই লাফিয়ে পড়ছেন।
এলাকার সুযোগ সন্ধানী ‘বৈদ’শিকারি নামে পরিচিত হালিম মিয়া তখন পর্যন্ত ‘সাইত’ করতে পারেননি। বললেন, দুই বিলে নামতে নামতে মাছুয়ার সংখ্যা প্রায় হাজার হয়ে যাবে। কেউ ২০ থেকে ২৫টা মাছ পাবে, আবার কাউকে শূন্য হাতে ফিরতে হবে।
প্রবীণ শিক্ষক ফেরদৌস হোসেন বললেন, কোন কাল থেকে এই অঞ্চলে বৈদ নামের এই মাছ ধরা চলে আসছে তা বলা কঠিন। বৈদ নামে প্রকৃত অর্থ কি তা-ও জানি না। সাধারণত কার্তিক মাসের প্রথমদিক থেকে শুরু করে মাঘ মাস অবধি যখন বড় বড় বিল, নদী ও খালে পানি কম থাকে তখনি এই দলবদ্ধ বৈদ নামের মাছ ধরার প্রকৃত মৌসুম।
কথা বলে আরো জানা গেল, জেলার ৬টি উপজেলাতেই রয়েছে পৃথক পৃথক সৌখিন এই মাছশিকারির দল। বৈদ দলের আলোচনার ভিত্তিতে মাছ শিকারের নির্দিষ্ট জলাশয়, তারিখ, সময়, যাত্রার স্থান নির্ধারণ করে গ্রামের হাট-বাজারে ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়। এই বৈদের দলের একজন দলনেতা থাকে। যার কাছে থাকে মহিষের শিং দিয়ে তৈরি বড় একটি বাঁশি। যাকে বলা হয় বৈদের শিংগা। যা দিয়ে বিউগলের মতো উচ্চস্বরে শব্দ বের হয় এবং অনেক দূর থেকে তা শোনা যায়।
নির্ধারিত স্থানে যথাসময়ে শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হয় বার বার। আর শিংগার আহ্বানে নিজ নিজ পছন্দমতো মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম নিয়ে সমবেত হতে থাকে মৎস্য শিকারিরা। পূর্বনির্ধারিত বিল জলাশয়ে দলবদ্ধ হয়ে মাছ শিকার চলে দিনভর। এতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, যে কেউ এতে শামিল হতে পারে। বৈদে মাছ মারা চলে সকাল থেকে বিকেল ৫টা অবধি এক জলাশয় থেকে অন্য জলাশয়ে। এতে অনেক মাছ পায় আবার অনেকে একটি মাছও পায় না। কিন্তু তাতে বৈদ শিকারিদের কোনো দুঃখ নেই। কেননা এখানে দলবদ্ধভাবে মাছ ধরতে যাওয়ার আনন্দটাই মুখ্য, মাছ প্রাপ্তিটাই মূল বিষয় নয়।
তবে অভিমান-অনুযোগও আছে তাদের। কৃষক মকবুল বললেন, আগে বৈদ দল জলাশয়ে নামলে সবাই খুশি হতো। ভিড় করে দেখতে আসত। কিন্তু আজকাল কোথাও কোথাও মালিকানা দাবি করে বাধা দেওয়া হয়। আমরা নিজের ও অন্যের আনন্দের জন্য পানিতে নামি। কারো ক্ষতি করতে নয়।
Leave a Reply