স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষিখাততে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো ও ঝুঁকি মোকাবিলার বাজেট চায় বিএনপি। তাই আসন্ন বাজেটে এই তিন খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ করে মোট ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছে দলটি। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পাঁচ দিন আগে শুক্রবার সকালে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৪ দফা বাজেট ভাবনা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, অনেকে মনে করেন করোনার ভয়াবহতা না-কমলে গতানুগতিক বাজেট করে কোনো লাভ নেই। লক্ষ্য হওয়া উচিত আগামী ছয় মাসের জন্য একটি অন্তর্র্বর্তীকালীন বাজেট করা। কারণ, করোনার কারণে পূর্ণাঙ্গ বাজেটের কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হবে না। আবার অনেকে মনে করে, অর্থনীতির অস্বাভাবিক সংকোচনে প্রচলিত বাজেট ব্যবস্থা থেকে সরে এসে তিন বছর মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। বিদায়ি অর্থবছরে আমরাও এই দাবি করেছিলাম। কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, এবারের বাজেট হওয়া উচিত জীবন বাঁচানোর বাজেট, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকি মোকাবিলার বাজেট। জীবন ও জীবিকার সমন্বয়ের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তবে জীবন সবার আগে। এবারের বাজেট হবে করোনাভাইরাসের নিয়ন্ত্রণ ও অভিঘাত থেকে উত্তরণের বাজেট। বর্তমান বিরাজমান জটিল, সংকটজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো জীবন ও জীবিকার সমন্বয়ে সাধন করে কাযর্করী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিএনপি এবারের বাজেটকে শুধু নির্দিষ্ট অর্থবছরের হিসাবের চেয়ে আগামী দিনের অর্থনীতির সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশের যাত্রাবিন্দু হিসাবে দেখতে চায়। সেই লক্ষ্যে বিএনপি আগামী বাজেটকে ভবিষ্যতের অর্থনীতির নীতিকৌশল হিসাবে ‘সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ অর্থনীতি’ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার হিসাবে দেখতে চায়।
তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, একটি দেশের অর্থনীতি তখনই সত্যিকার অর্থে জনবান্ধব হয়ে ওঠে, যখন সেখানে সুশাসন ও জবাবদিহিমূলক সরকার জনগণের অবাধ নিরপেক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়। সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মূলমন্ত্র হচ্ছে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগের সর্বোত্তম পন্থা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা; যা বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত।
২৪ দফা প্রস্তাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষিখাতে জিডিপির ৫ শতাংশ করে বরাদ্দের কথা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, স্বাস্থ্যখাতকে বাজেটের সর্বাধিক তালিকায় রাখতে হবে। চলমান বৈশ্বিক মহামারি প্রতিরোধ ও করোনা চিকিৎসা দুটিই সমানতালে চালিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাখাতে বিএনপির ভিশন ২০৩০-প্রদর্শিত পথে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধ, বৃত্তি প্রদান, প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, কোভিডকালে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষায়াতনে আর্থিক সহায়তা প্রদান, গবেষণা ও অবকাঠামো উন্নয়ন ও উচ্চশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে শিক্ষাখাতে বরাদ্ধ বৃদ্ধি করতে হবে। একইসঙ্গে কৃষি, শিল্প ও সেবাখাতের বহুমুখীকরণ, উৎপাদন, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো কৌশলগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষিখাতে জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবিসংবলিত ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ২৮ পৃষ্ঠার বাজেট ভাবনায় কর্মহীন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য জিডিপির ৬-৭ শতাংশ, ‘দিন আনে দিন খান’ শ্রেণির মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে ১৫ হাজার টাকা করে তিন মাসের প্রণোদনা প্রদান, নিরপেক্ষভাবে দুস্থ উপকারভোগীর তালিকা প্রণয়ন করে ‘দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা সহায়তা প্যাকেজে’র আওতায় আনার প্রস্তাব করেন বিএনপির মহাসচিব।
কৃষি কমিশন গঠন, রপ্তানি বহুমুখীকরণে বিকল্প বাজারের অনুসন্ধান, টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মহামারির মতো সংকট মোকাবিলায় পর্যাপ্তসংখ্যক বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ, জাতীয় স্বাস্থ্য কার্ড চালু, প্রত্যেক জেলায় ডেডিকেটেড সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, করোনাকালে জেলা হাসপাতালগুলোয় করোনা বেড, আইডিইউর সংখ্যা বৃদ্ধি, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উৎস্য থেকে বিদেশি অনুদান বাড়ানোর কথাও বিএনপির বাজেট প্রস্তাবে রয়েছে। বাজেট প্রস্তাবে মির্জা ফখরুল শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের নিয়ে উচ্চপর্যায়ে একটি ‘অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
মেগা প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, মেগা প্রকল্পের মেগা দুর্নীতির সব কাহিনি সবাই জানেন। দেখা গেছে, সরকার সাধারণ মানুষের সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের চেয়ে মেগা প্রকল্প গ্রহণেই বেশি আগ্রহী। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে কীভাবে অর্থ বরাদ্দের নামে মহাদুর্নীতি করা হয়েছে-তাও তুলে ধরেন বিএনপির মহাসচিব।
কালোটাকা সাদা করার সরকারি নীতির কঠোর সমালোচনা করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, আসছে বাজেটেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘যত অপ্রদর্শিত আয় থাকবে, তত দিন এই সুযোগ থাকবে’। হরিলুট করে সঞ্চিত কালোটাকা জায়েজ করার দরজা অবারিত করে দিলেন অর্থমন্ত্রী; যা অনৈতিক এবং ন্যায়নীতি মেনে আইন পালনকারী নাগরিকদের প্রতি অবিচার বলে আমরা মনে করি।
কোভিডকালীন সময়ে এত কালোটাকা কারা আয় করেছে জাতি জানতে চায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদিও এরইমধ্যে সরকার দলীয় ও তাদের মদতপুষ্ট অনেক রাঘববোয়ালের নাম বেরিয়ে পড়েছে। অপ্রদর্শিত আয়ের একটি বিরাট অংশ মানি লন্ডারিং হয়ে যাচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার বেড়েছে।
বছরে লাখ কোটি টাকার অধিক পাঁচার হয়। প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তা দিয়ে চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হতো।
মির্জা ফখরুল বলেন, লকডাউনের ফলে সারা দেশে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে গরিব মানুষের জীবিকা বিপর্যস্ত হচ্ছে। বেসরকারি খাত-সংগঠিত খাতেই থাকুন বা অসংগঠিত খাতেই থাকুন, যারা চাকরিচ্যুত হচ্ছেন, তাদের জন্য অনতিবিলম্বে সামাজিক কল্যাণের (সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার) ব্যবস্থা করতে হবে। এ খাতে ৩ শতাংশ জিডিপি ব্যয় হবে। এরসঙ্গে রয়েছে নতুন দুই কোটি ৪৫ লাখ দরিদ্র, আগে থেকেই বেশকিছু কর্মহীন মানুষ আছেন, সামাজিক কর্মসূচির মধ্যে আছে এমন অনেকে আছেন, তাদের জন্য জিডিপির আরও ৩ শতাংশ ব্যয় হবে। এ খাতে জিডিপির ৬ থেকে ৭ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে এবং এই অর্থ আগামী চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যেই ব্যয় করতে হবে।
ব্যাংকখাতে চরম অব্যবস্থাপনা ও হরিলুটে ঋণখেলাপির চিত্র তুলে ধরেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, ঋণখেলাপিদের কবল থেকে দেশ ও অর্থনীতিকে মুক্ত করতে হবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলা হলেও তাদের আবার বিপুল ঋণ রাইট অফ করে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, ঋণখেলাপি ও ব্যাংক মালিকদের অনৈতিক সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। আরও ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শ্যামা ওবায়েদ, রিয়াজ উদ্দিন নসু, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার, চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল করিব খান প্রমুখ। এ ছাড়া ইন্টারনেটে যুক্ত ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা শামসুজ্জামান দুদু, শওকত মাহমুদ, হারুন আল রশিদ, ইসমাইল জবিউল্লাহ, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, শাহজাদা মিয়া, তাহসিনা রুশদীর লুনা, খন্দকার আবদুল মুক্তাদির, ফজলুল হক মিলন, মোস্তাক আহমেদ, অনিন্দ্র্য ইসলাম অমিত, জয়ন্ত কুমার কুণ্ড প্রমুখ।
Leave a Reply