চাল আমাদের খাদ্যতালিকায় প্রধান উপাদান, বিত্তবান থেকে মেহনতি মানুষ অর্থাৎ দিনমজুর- সবার। তাই চাল নিয়ে যখন-তখন মূল্যবৃদ্ধির চালবাজি নিম্নবর্গীয়দের জন্য মর্মান্তিক, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের জন্য আর্থিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিত্তবানের সে সমস্যা নেই। কথায় বলে, ‘ভেতো বাঙালি’—আর যা-ই না থাকুক, ভাত না হলে নিম্নবর্গীয় বাঙালির চলে না। তাই বাঙালির জন্য চালের কোনো বিকল্প নেই এবং তা সম্প্রদায়-নির্বিশেষে। আধুনিকতা অবশ্য উচ্চ শ্রেণিতে এ বিষয়ে মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
একাত্তরের সর্বজনীন চরিত্রের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে এমন একটি ধারণার স্বাভাবিক প্রাধান্য ছিল যে স্বাধীন বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক পরিচালনা রাজনীতিকদের হাত ধরে চলবে, অন্যরা চলতি সঙ্গী। মূল মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে একাধিক উপশ্রেণি, রাজনীতিকরা তাঁদের অন্যতম। তবে এ সত্যটি অস্বীকারের উপায় নেই যে শিল্পপতি, বিশেষ করে বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তুলনায় অনেক বেশি শক্তিমান হয়ে উঠেছে। পর্দার আড়ালে তারা দেশের আসল পরিচালক।
পরিচালক শুধু সংসদে বসে নীতিনির্ধারণেই নয়, তারা প্রকৃতপক্ষে দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক, নিয়ন্ত্রক সর্বমাত্রিক পণ্যবাজারের। কিছুদিন থেকে ‘সিন্ডিকেট’ নামে যে মহাশক্তিমান শব্দটি নানা প্রসঙ্গে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটাই মনে হয় দেশের নেপথ্য পরিচালক হয়েও আসল পরিচালক। বেশ কিছুদিন আগে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি সরস কথাচ্ছলে বলেছিলেন, জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী সদস্যের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে।
কথাটার মর্মবস্তু খুব স্পষ্ট। সংসদে ব্যবসায়ী স্বার্থের প্রাধান্য দেখা দিতে পারে। স্বভাবতই মনে হয়, সংসদ থেকে সমাজে ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রাধান্য সূচিত হলে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থই সমাজজীবনে, জাতীয় জীবনে প্রধান হয়ে উঠবে। সে অবস্থা সাধারণ মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত বা নিম্নবর্গীয় স্বার্থের অনুকূল হওয়ার কথা নয়।
অপ্রিয় হলেও সত্যটা অস্বীকারের উপায় নেই যে বর্তমানে বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা সে পথ ধরেই চলছে। উল্লিখিত শ্রেণিগুলোর জীবনযাত্রা চলছে ওই বৃহৎ ব্যবসায়ী শ্রেণির মর্জির ওপর। একটি প্রাসঙ্গিক সত্য, সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক পণ্যের কেনাকাটা কী দরে হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে নির্দিষ্ট ‘সিন্ডিকেট’ তথা বৃহৎ পণ্য মালিক সমিতি। তাদের স্বার্থের হিসাব-নিকাশই আমাদের প্রয়োজনের হিসাব-নিকাশ।
এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, সরকার মধ্যস্থতায় সমঝোতা বৈঠকে বসে দামদস্তুর ঠিকঠাক করতে। সামান্য এদিক-ওদিক করে একটা সমঝোতায় পৌঁছানো হয়; কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের স্বার্থের খুব একটা সুবিধা হয় না। সম্ভবত আমরা ভুলে যাইনি এর আগে পেঁয়াজ নিয়ে প্রচণ্ড দুর্ভোগের কথা। ভুলে যাইনি সরকারের অসহায় অবস্থার কথা। তাদের বহুমাত্রিক প্রচেষ্টার পরও পেঁয়াজ ক্রেতারা খুব একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেনি। পরিস্থিতির শেষ পরিণাম হলো—খাতুনগঞ্জের পচা পেঁয়াজ সস্তা দামে বিক্রির চেষ্টা। মানুষ তাতে সায় দেয়নি।
গুরুত্বপূর্ণ পণ্যবাজার নিয়ে এই যে অন্যায়, মজুদদারি, কালোবাজারি-চোরাকারবারি—এর কি কোনো ব্যবস্থা কিংবা আইনগত শাস্তির ব্যবস্থা নেই? আজ পর্যন্ত এই দুর্নীতিবাজদের যোগ্য শাস্তি হয়েছে কি জনগণের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণের অভিযোগে অর্থাৎ কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, যাতে তারা এই অপরাধপ্রবণতা হ্রাস পায়? ফলে একেক সময়, একেক বহু ব্যবহৃত পণ্য নিয়ে সিন্ডিকেটের চলে মূল্যবৃদ্ধির খেলা। শতকোটি, হাজার কোটি টাকার খেলা। মানুষ এসব নিয়ে আলোচনা করেই শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করে।
বছর কয় আগে চাল নিয়ে চলেছিল সিন্ডিকেটের এমন মানবতাবিরোধী, নির্মম অবৈধ খেলা—হঠাৎ করে চালের দাম কেজিপ্রতি আট টাকা বাড়িয়ে দিল সিন্ডিকেট। দরিদ্র মানুষ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে সবারই প্রবল অস্বস্তিতে শুধু আলোচনা আর আলোচনা। কারো মুখে শোনা গেল, এবার খোদ সঞ্চয়পত্রে হাত দিতে হবে। সুদ নয়, আসলে হাত।
সরকার চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসল দফায় দফায়। বহু বৈঠকের পর অবৈধ আট টাকা বৃদ্ধি কমে ছয় টাকায় দাঁড়াল। এর আগে স্বাভাবিক দাম বেড়ে ছয় টাকায় দাঁড়াল। অসহায় মানুষ তা-ই মেনে নিল। আশ্চর্য, কেউ কোনো প্রকার প্রতিবাদে নামেনি, মিছিলে রুখে দাঁড়ায়নি।
দুই.
আবার চাল নিয়ে এখন সিন্ডিকেটবাজি, মানুষের ক্ষুধার পণ্য নিয়ে মুনাফাবাজি, উদ্দেশ্য কালোবাজারি, চোরাকারবারির মাধ্যমে শ্রেণিবিশেষের কিছু মানুষের অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ে তোলা। একটি দৈনিকের খবর (১৩.১২.২০২০) : ‘ভরা মৌসুমে অস্থির চালের বাজার’, অন্য একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রতিবেদন-শিরোনাম : ‘চালের বাজারে আগুন’। আরেকটি দৈনিকের শিরোনাম : ‘চাল-তেলের দামে লাফ’ (১৫.১২.২০২০)।
অর্থাৎ শুধু চাল নয়, ভোজ্য তেলেও মূল্যবৃদ্ধির ‘ভূতের আছর’—পেছনে যুক্তি থাক বা না থাক। রান্নাঘরে এই পণ্যটিরও ভূমিকা কম নয়, তেল না হলে খাবার তৈরি হয় না। আপাতত চাল নিয়েই কথা বলা যাক। এক টাকা নয়, দেড় টাকা নয়, এক লাফে কেজিপ্রতি আটটা বেড়েছে চালের দাম, তা-ও দুই সপ্তাহের মধ্যে। মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্য নিয়ে খেয়ালখুশিমতো দাম নিয়ে খেলা, প্রতিবাদের জোরালো কণ্ঠস্বর নেই, প্রতিরোধ তো দূরের কথা।
খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, কয়েক দিনের মধ্যেই মিল মালিকদের সঙ্গে তাঁরা বৈঠকে বসবেন চালের দাম নিয়ে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে। আমাদের কথা—এত নরম স্বরে চিড়ে ভিজবে না। সরকারকে যুক্তিতর্কে-তথ্যে কড়াচড়া হাতে মুনাফাবাজদের মোকাবেলা করতে হবে। ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ানো চলবে না—এটাই হোক শেষ কথা। যদি কোনো তথ্যগত যুক্তি থাকে, তবে যুক্তির পথে তার ফায়সালা করতে হবে।
আমরা বিভিন্ন ধরনের চালের দামের পূর্বাপর পরিসংখ্যান উল্লেখ করে লেখার পাতা ভরাতে চাই না, সে জন্য দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদনই যথেষ্ট। আমরা যুক্তিতর্কের পথে চলতে চাই। ভোক্তা অধিকার বিষয়ক একটি সংস্থা সিসিএসের নির্বাহী পরিচালক চালের বাজারের অস্থিরতা নিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।’ তাঁরও বক্তব্য, সরকার চেনে কারা চালের দাম বাড়ানোর পেছনে, তাদের সঙ্গে অবিলম্বে বসে বিষয়টির যুক্তিসংগত ফায়সালা করা উচিত।
তিন.
পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, নানামুখী কড়া ব্যবস্থার তাস হাতে নিয়ে দ্বন্দ্বে না নামলে চালের দাম বাড়ানো বন্ধ করা সম্ভব হবে না। কারণ চালের মজুদ মিল মালিকদের এখতিয়ারে, সেখানে তারা রাজা। প্রতিবছর তারা একই ধরনের খেলায় সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করে। এর মাসুল গোনে সাধারণ মানুষ, মেহনতি মানুষ, দিনমজুর প্রমুখ, যাদের প্রতিদিনের উপার্জন থেকে ঘরের ক্ষুধা মেটাতে হয় চাল কিনে।
আমরা মনে করি, কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ধান বিক্রয় থেকে চালের বাজারের প্রতিটি ধাপে সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ সক্রিয় থাকা দরকার, যাতে চালের বাজার ও চালের দাম নিয়ে কোনো প্রকার ভোজভাজি খেলা না চলতে পারে। তা না হলে প্রতিবারের মতো মুনাফাবাজ মিল মালিকদের একই ধরনের খেলা চলতে থাকবে।
এরই মধ্যে আরো একটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে, আর তা হলো, সুস্থ সামাজিক শক্তির জাগরণ। শুধু চাল বা তেল বলে কথা নয়, জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি অত্যাবশ্যক পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে জনবান্ধব সামাজিক শক্তির বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকা দরকার। দরকার প্রতিবাদে, প্রতিরোধে যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পক্ষে।
আমাদের সামাজিক শক্তির দুর্বলতা পণ্যবাজারের অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের বড় একটি কারণ। আর সে কারণের সূত্রে বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সিন্ডিকেট তাদের ইচ্ছামতো অত্যাবশ্যক পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে, আর সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী লাভটাই হয়ে ওঠে বড় অঙ্কের।
এজাতীয় বিষয়গুলো স্মরণে রেখে সরকারের সাধারণ মানুষ, মেহনতি মানুষের বেঁচে থাকার পণ্য সম্পর্কে সচেতনতা নিয়ে নীতিনির্ধারণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। না হলে বিত্তহীনদের অর্ধাহার-অনাহার অনিবার্য।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী
Leave a Reply