1. iamparves@gmail.com : admin :
  2. najmulhasan7741@gmail.com : Najmul Hasan : Najmul Hasan
  3. janathatv19@gmail.com : Shohag Khan : Shohag Khan
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৯:৪৬ অপরাহ্ন

‘খেরোখাতার গেরো’শফিক হাসান-এর গল্প

শফিক হাসান
  • প্রকাশের সময় : শুক্রবার, ৬ মে, ২০২২

বাস থেকে নামলেই এক শ্রেণির পেশাজীবী বরাবরই দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। অতি বেপরোয়া কেউ কেউ নিচু স্বরে বলেও যায়, ‘নতুন মাল আছে, যাইবেন?’ কেউ আবার বলে, ‘খাইবেন?’ যাওয়া ও খাওয়ার বিষয়টি প্রথম দিকে আজগর মল্লিককে বিব্রত করলেও ধীরে ধীরে গা-সওয়া হয়ে গেছে। সবাই তো চাইবে যার যার পেশায় ‘সাফল্য’ পেতে। ব্যবসা থেকে লাভ তুলে আনতে। অন্যরা যত চাটবে তাদের তত পোয়াবারো। বছর দুয়েক যাবত ব্যবসাটা এগিয়ে গেছে আরও একধাপ।

ফুটওভার ব্রিজের উপরে-নিচে, আশপাশে অনেক আকার-আকৃতির ভিজিটিং কার্ড দেখা দিতে শুরু করেছে। কার্ডগুলোতে ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত নামের পাশে লেখা থাকে ‘ভাই’। অমুক ভাই-তমুক ভাই। সংক্ষিপ্ত ঠিকানার সঙ্গে থাকে বড় পয়েন্টে ছাপা সেলফোন নম্বর। এখানেই শেষ নয়। সুদৃশ্য একটা লাল গোলাপ কিংবা দুগ্ধশাদা খাট-শয্যার ছবিও মেলে। একবার কম বয়সী একটা ছেলে ফুটওভার ব্রিজে দাঁড়িয়ে বিলি করছিল কার্ড, অন্যদের সঙ্গে একটা পড়ল আজগর মল্লিকের হাতেও। প্রথম দর্শনেই তিনি বুঝে ফেললেন ব্যবসার ধরন। বিশেষ করে ঠিকানা গোপনের পাশাপাশি ‘শতভাগ নিরাপত্তা’ ও ‘আসার আগে কল করবেন’ ধরনের বার্তা ধারণাকে শক্ত ভিত দিল।

জাতীয় হয়েও ‘কম-জাতীয়’ একটি দৈনিকের সাব এডিটর আজগর মল্লিক। কোনো খবর কিংবা বেখবর গোপন থাকে না তার কাছে। কম লোকবলের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছেন খবরের খনি। নানা প্রান্ত থেকে সাংবাদিক ও সম্বাদিক ভাইয়েরা তুলে ধরেন হাল-চিত্র। বিজ্ঞাপন প্রতিনিধিদের খবরের ধরন আবার একটু ভিন্ন। চিত্র-বিচিত্র সেই চালচিত্রে আজগর মল্লিক প্রথম দিকে হিমশিম খেতেন। এখন প্রাত্যহিক অভ্যস্ততা এসে গেছে। মাঝে-মধ্যে ডেস্কে বসে কিছু প্রতিবেদনও তৈরি করতে হয়। সেটাও সহজ। ব্যাকরণ বইয়ের যে কোনো রচনার ছাঁচে ফেলে দিতে পারলেই বাইনেমের কিঞ্চিত ভালোলাগার উপাখ্যান।

সেদিন বিকালে টেলিভিশন স্ক্রলে দেখা গেল খবরটা। তোদাবাড়ি এলাকায় নারী খুন। বিস্তারিত খবরে জানা যায়, এক তরুণীকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে রুম ভাড়া নেয় তরুণ। ঘণ্টাখানেক পরে তরুণীর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। ঘাতক প্রেমিক পলাতক। স্থানীয় প্রতিনিধি প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিয়েছে কিছুক্ষণের মধ্যেই। যথারীতি তার প্রতিবেদনে মিলল আরেকটি সংবাদমাধ্যম অগ্রসর বার্তা ফর্টি এইট ডট কমের অস্তিত্ব। আজগর মল্লিক এমন দ্বৈত আচরণে এখন আর বিরক্ত হন না। এই প্রতিষ্ঠানে সাড়ে তিন বছর চাকরির সুবাদে বুঝে গেছেন, সব লড়াইয়ের বড় লড়াই হচ্ছে দুর্দিনে টিকে থাকা। কিছুক্ষণ পর বার্তাপ্রধান পিয়াল রহমানের কক্ষ থেকে ডাক পেলেন তিনি। পিয়াল ভাই কম কথায় বেশি কাজের লোক। বললেন, ‘একটা স্পেশাল স্টোরি কর। দেহ বিকিকিনি : কেন বাড়ছে অপরাধ।’

নিজের দেখা ও উপলব্ধি, চারদিকের অপ্রেমজনিত ধর্ষণ-হত্যা এমন কয়েকটি কেস স্টাডি মাথায় নিয়ে প্রতিবেদনটি দাঁড় করিয়ে ফেললেন একঘণ্টার মধ্যেই। পিয়াল ভাই স্টোরিটা এতই পছন্দ করলেন, অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করে লাল কালিতে লিড করে দিলেন পুরো আট কলামে। ভেতরে বক্স আইটেম হিসেবে থাকল একজন নারীবাদী ও একজন মানবতাবাদীর ছবিসহ মন্তব্য-শিরোনাম। আজগর মল্লিক সচরাচর নিজেদের কাগজ কেনেন না। অফিসে পৌঁছালেই নিজের ডেস্কে এক কপি সৌজন্য পান। আজ বাসে ওঠার আগেই ‘নিজস্ব নিউজ’ কাগজটি কিনলেন। পিয়াল ভাই কোথায় কী সংযোজন-বিয়োজন করেছেন বাসে বসে পড়তে পড়তে যাওয়া যাবে। লেখা ও সম্পাদনা দুটোই যুৎসই হয়েছে- মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ালেন। কিন্তু এই ভালোলাগা বোধ বেশিক্ষণ টিকল না। ফুটওভার ব্রিজ পার হতে যাবেন, এমন সময় দেখা পেলেন ‘নিশ্চুপ’ হকারের। লোকটা কখনই তাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেনি। আজকের বিশেষ দিনে লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখে একপ্রকার ভড়কেই গেলেন আজগর মল্লিক। লোকটা নিচু স্বরে বলল, ‘হিস্টরিডা ভালাই লেখছস, তয় ইনট্রোডা এমন করলি ক্যান! গ্রাম-গঞ্জে, নগর-মহানগরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে নিষিদ্ধ ব্যবসা- গাঞ্জাখুরি সূচনা এইডারেই কয়।’

‘শত্রুপক্ষ’ প্রতিবেদন পড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে সেটা সুখকর বিষয় থাকে না। তবুও আজগর মল্লিকের ভালো লাগল, তাদের প্রচারসংখ্যায় নি¤েœর কাগজটিও লোকজন পড়ে। কিন্তু তাকে সনাক্ত করল কীভাবে! তুই-তাই সম্বোধনটা ভালো লাগে না কখনই। অপরিচিত মানুষ হলে তো কথাই নেই। সেই বিরক্তি প্রকাশ করার চেয়ে আজগর মল্লিকের বিস্ময় ঠেকল, অপাত্র কীভাবে সাংবাদিকতার পাঠ দেয়! বললেন, ‘আগামীতে নিশ্চয়ই আরও সতর্ক থাকব। কিন্তু সমস্যাটা আপনি সনাক্ত করতে পারলেন কীভাবে!’

‘এইডা কঠিন কিছু?’
‘অবশ্যই কঠিন। সাধারণের জন্য তো আরও বেশি!’
‘ওরে পাগলা, আমিও তোর মতোই সাংবাদিক ছিলাম!’
‘কী বলেন! আপনার বর্তমান পেশার সঙ্গে এটার ন্যূনতম সম্পর্কও দেখছি না।’
‘বেতস পাস না কত মাস?’
‘প্রায় দেড় বছর।’
‘আমার কত বছরের বাকি পড়েছিল মনে নাই তোর?’
‘উল্টাপাল্টা কী সব বলছেন!’
“তুই ভুইলা গেছস আমারে? আমরা তো একত্রে ‘ভূমিষ্টকাল’ পত্রিকায় কাজ করেছি!”
এতক্ষণে চোখে ভাসল দিনু মোতালেবের চেহারা। সেই দিনুর এই হাল! বিস্ময় সামলাতে না পেরে আজগর মল্লিক বললেন, ‘এ কী দেখলাম, দোস্ত! তোর এমন অবস্থা কেন?’
‘একই প্রশ্ন আমারও। তুই এখনো টিকে আছিস কী করে? নাকি পেশার নাম ভাঙিয়ে অন্যকিছুও করিস!’
‘না রে। বিয়েথা করিনি। তাই হয়ত এখনো সততাটা ধরে রাখতে পেরেছি। বাবার অল্প কিছু জায়গাজমি থাকলে আরও আগেই গ্রামে চলে যেতাম।’
‘ল সামনে যাই, চা খাই।’

চায়ের স্টলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আজগর মল্লিক বলেন, ‘আঞ্চলিক ভাষায় বাতচিত করছিস যে!’
দিনু মোতালেব হাসতে হাসতে বলল, ‘ভদ্রলোকের ভাষা এখানে চলবে না। প্রমিত বাংলাটাও বলি, তবে অন্য জায়গায়।’
‘কোন জায়গায় সেটা?’
‘সব শুনবি। আগে চা খা।’

চায়ে তৃতীয় চুমুক দিয়ে আজগর মল্লিক সেলফোনটা হাতে নেন ‘পিয়াল ভাই, আজ আসতে পারব না। একটা জরুরি কাজে আটকা পড়েছি। কষ্ট করে চালিয়ে নিন।’
অদূরের রেললাইন থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে দিনু মোতালেব শুরু করে তার গল্প। জীবন ও যৌবন ক্ষয়ের গল্পগাথা। শুনতে শুনতে বিস্ময় বাঁধ মানে না আজগর মল্লিকের।

দুই.

সব হিসাবনিকাশ, ব্যাকরণ পাল্টে দিল দিনু মোতালেব। ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর টানা চারদিন অফিসে যাননি আজগর মল্লিক। কেমন একটা বীতশ্রদ্ধ ভাব চলে এসেছে পেশার প্রতি, জীবন ও জগত হয়ে উঠল বিতৃষ্ণার আধার। মনে পড়ল প্রিয় কবির পঙ্ক্তি- মিছে এ জীবনের কলরব। এর মধ্যে পিয়াল ভাই কল করেছেন তিনবার। জানতে চেয়েছেন, সমস্যা কী। তিনি শুধু বলেছেন, সমস্যা নয়, শরীরটা ভালো লাগছে না।

শেষবার ঝাড়ি না দিয়ে হালকা রসিকতা করেছেন পিয়াল ভাই- ‘জানি তো। নিয়মিত বেতন না পেলে কারওরই শরীর-মন ভালো থাকে না। মন বসে না কাজে।’
‘না, ভাই, বিষয়টা তা নয়।’

‘কোথাও যদি চাকরি পেয়ে থাকো, তাহলে অফিসে চলে এসো। জানো তো, একসপ্তাহের ছুটি নিয়ে হিমাদ্রিশেখর বাড়িতে গেছে। ওর বিয়ের লগ্ন পড়েছে; এবার আর পেছানোর সুযোগ নেই। এদিকে নতুন ছেলেটা এখনো কম্পোজ শিখে উঠতে পারেনি।’
‘আচ্ছা, দেখছি।’

চারদিন পরে অফিসে গেলে প্রথমেই ডাক আসে সম্পাদকের রুম থেকে। সম্পাদক মহোদয় একসময় ছাত্ররাজনীতি করতেন। ছাত্রত্ব বিদায়ের বয়স একযুগ পেরিয়ে যাওয়ার পর শুরু করলেন যুব-রাজনীতি। এর ভেতরেই আবার শুরু করেছেন প্রেস ব্যবসা।

বারেক তহশীলদার বললেন, ‘আজগরের তো চেহারা সুন্দর হয়ে গেছে এই ক’দিনে!’
আজগর মল্লিক জবাব দিলেন না। হাসলেন। মৃদুস্বরে বললেন, ‘আমি কোনো ক্রিম ব্যবহার করি না, ভাই।’
‘ক্রিম লাগবে কেন। যৌবনের আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে না! সেটাই মাঝে-মধ্যে খোলতাই হয়।’
নীরব রইলেন তিনি। বুঝে উঠতে পারলেন না কী বলবেন। সেটা আঁচ করতে পেরেই বারেক তহশীলদার বললেন, ‘এবার আমাদের কাগজটাকেও সুন্দর করা চাই। বুঝলে!’
‘সেটা তো আছেই। তুলনামূলক সুন্দর অবশ্যই।’
‘আরও সুন্দর করতে হবে। প্রেমের পড়ার পর তুমি কবিতা লিখেছ না?’
‘না। তবে কলেজের দেয়ালিকায় লিখেছি।’
‘গুড। এবার তাহলে কাগজেও দেয়ালিকা বানাও।’
‘বুঝলাম না।’
‘এখন থেকে প্রতি সোমবারে এক পাতা সাহিত্য আয়োজন করতে চাই। আমি চাই কাজটা তুমিই করো।’
যুক্তি দেখালেন আজগর মল্লিক ‘সেন্ট্রাল ডেস্কে মাত্র পাঁচজন লোক কাজ করি আমরা আমরা। এর মধ্যে আবার ফিচার ঢোকাচ্ছেন কেন!’

বারেক তহশীলদার হাসলেন। বললেন, ‘বিচার না করে কিন্তু ফিচার-ভাবনা আনিনি। নানা ধরনের ফিচার আয়োজন থাকলে আমাদের কাগজ মানুষের আরও কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। ইপেপার রাখার ব্যবস্থা করছি। তখন দেখবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কীভাবে উপচে পড়ে নিজস্ব নিউজ!’

কথাটা মিথ্যা নয়। প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে বেড়েছে সৃজনশীলতার শ্লীলতাহানিও। শ্রীবৃদ্ধিও ঘটেছে। অনেকেই এখন মনের ভেতরকার আকুলি-বিকুলি ঢেলে দিচ্ছে সহজেই। যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে এরাই হিট বানিয়ে দেয়, ভাইরালও করে। গুগল অ্যাক্সেসে এসব আবার ভালোই মুনাফা দেয়। যদি কেউ ব্যবসায়িক বিষয়টা ভালো বিষয়টা জানে-বোঝে, তাহলে কাজে লাগাতে পারে।

সম্পাদকের মুখের উপর না বলা যায় না। পরের সোমবারেই বেরিয়ে গেল সৃজন সাময়িকী ‘মন ও মাটি’র সূচনা সংখ্যা। নামটা পছন্দ করল অনেকেই। পাতাটাও। হিট হয়েছে প্রচুর, অন্যদিকে শেয়ারও কম হয়নি। সৃজনপ্রয়াসীদের যাতায়াত বাড়ল অফিসে, টিএনটি নম্বরে কলও আসা শুরু করল। তবে বেশি জ্যাম লাগল ইমেইল আইডিতে।

তিন.

বেতন আরও অনিয়মিত হতে শুরু করল অফিসে। গুঞ্জন উঠল, ইচ্ছা করেই বারেক তহশীলদার সংকটটা জিইয়ে রেখেছেন। সবকিছুই ভেতরেই তিনি পলিটিক্স ঢুকিয়ে দেন। বিরক্ত হয়ে পুরনো কর্মীরা চলে গিয়ে নতুন কর্মী এলে তারই লাভ। এখন যেমন ছিঁটে-ফোঁটা দিতে হয়, তখন সেটাও লাগবে না। নতুন ছেলেমেয়েরা কাজ করতে পারার আনন্দেই উদ্গ্রীব থাকে। শিক্ষানবিসিকাল কেটে গেলে ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে পৌঁছানোর রাস্তা সুগম হবে। তবে বেতন কিংবা জীবিকার পন্থা নিয়ে ভাবতে হবে না তেমন কাউকেই।

এদিকে নিয়মিত কাজে সেন্ট্রাল ডেস্কে রাঘববোয়াল-কুমির-সর্প মারার পাশাপাশি আজগর মল্লিক মিনিগল্প, মিনিকবিতা, মিনিপ্রবন্ধ, মিনিনিবন্ধ, মিনিনন্দনতত্ত্ব, মিনিরিভিউ, মিনি ইন্টারভিউ- ইত্যাদি মালমশলা ঠেসে দিতে থাকেন প্রতি সপ্তাহেই। তার কেমন যেন নেশা ধরে যায়। সম্পাদনা বোধহয় একধরনের আফিম-নেশা। নেশার লাটিম ঝিম ধরে এতে! নইলে লোভনীয় চাকরির অফারেও তিনি কেন সায় দিলেন না! প্রত্যাখ্যানের খবরও চাপা থাকে না। অন্যরা ধরে নেয়, ‘মন ও মাটি’কে ঢাল বানিয়ে তিনি ভালোই দাঁও মারছেন। গুঞ্জন আরও বাড়তে থাকলে আজগর মল্লিক মালিকপক্ষের ‘সিআইডি’ অভিধায়ও ভূষিত হতে থাকেন। তার অভাবনীয় সাফল্যে বারেক তহশীলদার বেজায় খুশি। সেটাও বিরুদ্ধপক্ষের বিরোধিতার পালে দিয়েছে নতুন আলো-হাওয়া।

সব রাগ-দ্বেষের বিপরীতে প্রতি সপ্তাহেই এতগুলো আনন্দিত মুখ দেখতে ভালোই লাগে আজগর মল্লিকের। পাপপুণ্য নিয়ে তার মনে বরাবরই একধরনের সংশয়ের দোলাচল ছিল। কিন্তু ইদানীং তিনি বুঝে ফেলেছেন, পুণ্যের মানে। অন্যকে যিনি আনন্দিত করতে পারেন তিনিই বড় পুণ্যবান। ওই হিসেবেও দিনু মোতালেবের নামটাও পুণ্যবানের খাতা থেকে খারিজ করতে পারেন না আজগর মল্লিক। দিনু এখন মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার লাইনে আছে। এর আগে তার লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ট্যাক্সিক্যাব চালাবে। সেটাও নাকি নানা কারণে জটিল হয়ে গেছে। ব্লগার কোটায় উন্নত রাষ্ট্রে যাওয়ার চিন্তাও বাদ দিয়েছে সে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমালোচনা সবসময় শুভ ফল দেয় না।

চার.

‘মন ও মাটি’র একনিষ্ঠ পাঠক পিয়াল রহমান। একদিন তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘এমন সব অচেনা লেখক তুমি কোথায় পাও?’
অন্য কেউ কথাটা বললে উষ্মা প্রকাশ করতে পারতেন আজগর মল্লিক। তিনি জানেন পিয়াল ভাই অন্য কিছু ভেবে কথাটা বলেননি। যুগ্ম সম্পাদক বাহার মুনশি সেদিন ঠাট্টাচ্ছলে বললেন, “আজগরের তো বেতন না হলেও চলে। ‘মন ও মাটি’র ফসল আছে!”

রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলেছিলেন আজগর মল্লিক। তিনি জানেন, এসব ভেবে সহকর্মীদের কেউ কেউ সুখ পায়। তা পাক, অনেক অপ্রাপ্তির মধ্যে এমন গুঞ্জন-সুখ কেউ পেলে সেখানে মনোক্ষুন্ন না হলেও চলে। নরম উদরটির জন্য অনেককেই গণ্ডারের চামড়া ধারণ করতে হয়। আজগর মল্লিক এসব ভেবে তেমন কঠিন রাগ করেন না।

পিয়াল ভাইয়ের কথার জবাবে বললেন, ‘এই লেখকরা পৃথিবীরই বাসিন্দা। কেউ দেশে থাকে, কেউ বিদেশে। বাংলা জানে সবাই, ইংরেজি বা আরবি জানে কেউ কেউ।’
‘তবে যে যাই বলুক, বাজারটা তুমি ভালোই জমিয়েছ। সম্পাদক মহোদয়ও দারুণ খুশি। আবাদের আরও ক্ষেত্র খুঁজছেন এখন।’
‘তাহলে চলেন, আগামীকাল সরেজমিনে বাজার দেখে আসি!’
‘কোথায়, কোন বাজারে যাবে?’
‘গ্রামের বাজারে যাব। কাল আপনার ডে অফ। আমি একদিনের জন্য ছুটি নিচ্ছি।’
‘ঠিক আছে।’
‘তাহলে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপাতত পেস্টিংয়ে বসি গিয়ে।’

পাঁচ.

‘মন ও মাটি’ পাতায় যত লেখা আসে, অধিকাংশেই থাকে প্রেরকের নাম-ঠিকানা ও সেলফোন নম্বর। পাতাটি প্রকাশিত হয়েছে আজ। প্রকাশিত হয়েছে আনকোরা একজনের লেখা। তার ঠিকানা ও ফোন নম্বর কাগজে লিখে নিয়েছেন আজগর মল্লিক। বরমাকান্দি বাজার খুঁজে বের করতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। পিয়াল ভাই ভাবেননি, বাজার দেখতে তাকে অনেক দূরের জেলায় যেতে হবে। আজগর মল্লিকের মনে মনেই ছিল সব!

অটোরিকশায় বাজারে নেমে বেশি হাঁটতে হল না। গ্রামের সবুজ ও ছায়া মাড়িয়ে মেঠোপথের পাশে পড়ল একটি টং দোকান। সেখানে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন গ্রামের নানা বয়সী কয়েকজন। এক তরুণের হাতে দেখা গেল আজকের ‘নিজস্ব নিউজ’। পিয়াল ভাই চমকালেও আজগর মল্লিক রইলেন নির্বিকার। তাকে দেখে মনে হল, এমনটাই ঘটবে, আগেই জানতেন। বাঁশের বেঞ্চিতে বসে দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন।

পত্রিকা হাতের যুবকটি উপযাচক হয়ে কাছে এল। বলল, ‘এই দেখুন, আমার লেখা ছাপা হয়েছে আজ!’
জুয়েল ভাই হাতে নিলেন কাগজটি। আনন্দিত গলায় বললেন, ‘তাই তো!’
চায়ে সুরুত সুরুত চুমুক দিয়ে পা নাচাচ্ছেন মুরব্বি গোছের একজন। তিনি দুই আগন্তুককে লক্ষ করে বললেন, ‘জমিরের পোলাডা তো পাগল অইয়া গেছে। কী একখান লেকা ছাপা অইছে! রবীন্দ্রনাত কি এইসব করছে কোনোদিন?’
প্রতিক্রিয়া এল সঙ্গে সঙ্গেই। তার সামনে বসা ছোকরাটি ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘তুমি মোচলমান না চাচা? আমগো কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার নাম মুখে আনতে তোমার শরম লাগে?’
‘আরে বেডা, আমি তো কবির কতা কইছি। হিন্দু-মোচলমানের কতা কই নাই।’
ছোকরা আরও তেড়িয়া হল এবার ‘কবির কতা কইলে তুমি মোচলমান কবির কতাই কইবা। মালাউনের লগে কীয়ের পিরিত!’
পিয়াল ভাইয়ের হস্তক্ষেপ পরিস্থিতিকে নতুন মোড় দিল। নানান বাতচিতের মধ্যেই তিনি লেখাটা পড়ে শেষ করলেন। লেখককে বাহ্বা দিয়ে বললেন, ‘খুব সুন্দর। তুমি কি জানো, এই পাতার সম্পাদক কে?’
‘না। কীভাবে জানব! আমি কখনো ঢাকায় যাইনি।’
‘তোমার পাশেই তিনি আজগর মল্লিক।’
যুবকটির মধ্যে দেখা গেল একধরনের বিচলিত ভাব। কী বলবে, কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে বলে উঠল ‘আমার কী যে ভালো লাগতেছে, ভাই!’

গ্রামে কোনো খবর ‘রাষ্ট্র’ হতে সময় লাগে না। পনের মিনিটের মধ্যেই খবরটা চাউর হয়ে গেল সোবহান উদ্দিনের লেখা কাগজে ছাপা হয়েছে। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য বড় দুজন সাংবাদিক এসেছেন। সোবহান উদ্দিন একপ্রকার জোর করেই অতিথি দুজনকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। তার বইয়ের সংগ্রহ ও পাঠ-পরিধি দেখে বিস্মিত হতে হল দুজনকেই। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এমন নিবিড় পাঠ চলে, মননের পাঠকের সজীব অস্তিত্ব রয়েছে! সরাসরি না এলে বোঝা যেত না। সোবহান উদ্দিন আদতেই বুনোফুল।

ফেরার পথে আজগর মল্লিক বললেন, ‘আপনাকে এখানে কেন আনলাম বুঝতে পেরেছেন এবার?’
‘তোমার উদ্দেশ্য বোঝা জরুরি না। তবে আমার ভ্রমণ বৃথা যায়নি।’
‘এই যে দেখলেন নবীন লেখক, এদের ভেতরে যে আনন্দ-স্ফূর্তি এটুকু অনুভব করার জন্যই আমি ভালোবেসে পাতাটা করি। প্রতিষ্ঠিত লেখক, নামী লেখকদের পেছনে তাই কখনই দৌড়াইনি। কী হবে তেলা মাথায় তেল দিয়ে!’

‘অপসংস্কৃতিটা তো দাঁড়িয়েই গেছে। কারও নাম-ধাম হয়ে গেছে সবাই মিলে পেছনে লাগবে। তার আগে কেউই পুঁছবে না। এর মধ্যে তুমি ব্যতিক্রম হলে অন্যরা সন্দেহ করবে, এটাই স্বাভাবিক।’
“এই আনন্দটুকুই আমার জীবনের পাথেয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি ছেলে-মেয়ের এমন অমল উচ্ছ্বাসকে স্বর্গীয় মনে করি। আমার এই কাজে কেউ কেউ ‘অনৈতিক বাণিজ্য’ সংক্রান্ত পাপ খোঁজার অপচেষ্টা করে। কিন্তু আমি দেখি সব পুণ্য আর পুণ্য; অসংখ্য পুণ্যাত্মা চারদিকে।”
‘আমি কখনই তোমাকে অবিশ্বাস করিনি। আর সমস্যা-দীর্ণ ক্ষুধার্ত মানুষের সন্দেহে কিছু যায়-আসে না।’

মিনিট কয়েক হাঁটলেই বাজারের দেখা মিলবে। সেখানে অটোরিকশায় চড়ে প্রথমে যেতে হবে রহিমগঞ্জে। তারপর উঠতে হবে বাসে। কথার ভেতরেই দুজনের কথার মাঝখানে সামনে দাঁড়াল লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা এক লোক। বলল, ‘সম্পাদক সাব কে? তারে সালাম দিবার চাই!’
পিয়াল রহমান দেখিয়ে দিলেন আজগর মল্লিককে। কী থেকে কী হচ্ছে, বোঝার আগেই লোকটা আজগর মল্লিকের মুখে-মাথায় উপর্যুপরি কিল-ঘুষি চালাতে শুরু করল! একই সঙ্গে চলল তার মুখ ‘হালার পুতেরা, সব ভালা লেখা তোরা লেকস? আমাগো লেকা অয় না? আমগো লেকা তাই ছাপাবি না!’
পিয়াল ভাই নিরস্ত করেন লোকটাকে। অভিযোগে জানা গেল, সে এই পর্যন্ত ৭৪৬টা লেখা পাঠিয়েছে কাগজে। ছাপা হয়নি একটাও।

ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন আজগর মল্লিক। বললেন, ‘আক্রমণটা আরও আগে করলে লেখা ঠিকই ছাপা হয়ে যেত! ঠিকানা খুঁজে পাননি নাকি সাহস?’
‘আপনেরা সব হালাই এক। গেরামের মাইনষের লেখা ছাপবার চান না। আর আমরা হুদাই কত্তডি ট্যাকা নষ্ট করি পত্রিকা কিইনা!’
বাসে উঠে পিয়াল রহমান বললেন, ‘খুব লেগেছে? মন খারাপ কোরো না। আমি আগামীকালই অফিসে গিয়ে এখানকার স্থানীয় প্রতিনিধির নম্বর বের করে কল দেব। খবর করে ছাড়ব ওই ইতরটার। ব্যাটা সম্পাদক দেখেছে, আইন দেখেনি!’
‘তার দরকার হবে না। যা করার আমিই করব।’

পিয়াল রহমানকে অবাক করে দিয়ে পরের সপ্তাহে দুর্বিনীত লোকটির ছবিসহ একগুচ্ছ কবিতা ছাপা হল ‘মন ও মাটি’ পাতায়। নিচে সংশ্লিষ্ট সম্পাদকের প্রাসঙ্গিক নোট কেন লেখা ছাপা হয়, কেন হয় না!

ছয়.

চারদিকে প্রশংসার বান, জয়জয়কার। বিদ্বৎ সমাজের কল্যাণে নিজস্ব নিউজ’র নাম এখন অনেকেই জানে। এর ই-সংস্করণও বর্তমানে দেশ-বিদেশের অনেক পাঠকই পড়ছেন। দিনু মোতালেবও মন দিয়ে পাতাটা পড়ে। একদিন মন্তব্য করে বসল, ‘পাতাডা খারাপ বানাস নাই।’
‘এভাবে বললে কিছু বোঝা যায় না। নেতির ভেতরে ইতি, নাকি ইতির ভেতরে নেতি?’
‘একটা হইলেই হইল। বেতন পাইছস?’
‘গত মাসে সাড়ে সাত হাজার টাকা, এরপর…।’
‘বুঝছি। তাইলে ভালা কমু ক্যান! পাতা তো না, তেজপাতা।’
পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজ বের করে সে। একটা কবিতা লিখেছে। কথার মতোই কবিতাটা জ্বালাময়ী।
আজগর মল্লিক বললেন, ‘কবিতাটা আমাকে দে। আগামী সপ্তাহে ছেপে দেব।’
‘ভুলেও ওই কাম করিস না। তোর চাকরি টিকব না। আরও ঝামেলা হইবার পারে।’
‘ঝামেলার কিছু নেই। আর ছাপতে না দিলে এই কবিতা তুই কী করবি?’
‘মহৎ কিছু করবার না পারি, ল্যামিনেটিং কইরা তোগো মতো পেশাজীবীর কবরে লাগায়া তো দিতে পারুম।’
‘লাভ কী তাতে?’
‘কী আর অইব! সবকিছুর মইধ্যে লাভ খুঁজতে অয় না। মনে নাই, তুই-ই তো কইছিলি!’
আজগর মল্লিকের অনুরোধে কান দেয় না দিনু মোতালেব। তার এক কথা, অন্ধকার কবিতা চাপ বাড়াবে। এসব না ছাপলেই ভালো।

দিন যায়, রাত যায়, ভোর আসে, সকাল হয়। নিজস্ব নিউজ’র কাটতি বাড়ে, বেতনের খাতায় আরও বড় বকেয়া যুক্ত হয়।
দিনু মোতালেবকে এখন আর ফুটওভার ব্রিজে আশপাশে দেখা যায় না। কোথায় আছে সে, জানে না কেউই। ওর প্রেমিকা শেফালি এই রাস্তা দিয়েই আবাসিক হোটেলে যায় নিয়ম করে। শেফালিও কোনো সন্ধান দিতে পারে না। কে এল আর কে নিখোঁজ হল এসব নিয়ে ভাবেও না সে।

তবুও প্রতিদিন নিয়ম করে আজগর মল্লিক খুঁজে বেড়ান হারানো সুহৃদকে। তার খেরোখাতায় গেরো বাড়তে থাকে। সেখানে জমা হতে থাকে আরও আরও দিনু মোতালেবের মুখ।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

নামাজের সময়সূচী

  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৪:২৫
  • ১২:২৮
  • ৫:০২
  • ৭:০৭
  • ৮:৩০
  • ৫:৪৬